মাতৃভাষা ও ভাষা আন্দোলন
মুুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম:: এ বসুন্ধরার নানান দেশে রয়েছে নানান জাতি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা।এই পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রত্যেক প্রাণীরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। এমনকি একই দেশের একই ভাষা ভাষী মানুষের কন্ঠস্বর, উচ্চারণভঙ্গীও পৃথক পৃথক। এটি মহান প্রভুর কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন। ঐশীগ্রন্থ কোরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে-“আর তাঁরই অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও রংয়ের ভিন্নতা। নিশ্চয় এতে নিদর্শনাদি রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।”- সূরা রুম,আয়াত:২২
আমরা যে ভাষাতেই মহান আল্লাহকে ডাকি না কেন, তিনি ডাকে সাড়া দেবেন (যদি ডাকার মতো ডাকতে জানি)। কারণ, তিনি হলেন অন্তর্যামী। কবির ভাষায়-
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ – সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন।- আবদুল হাকিম, বঙ্গবাণী
যুগে যুগে মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হেদায়তের জন্য বিভিন্ন গোত্রের স্ব-স্ব ভাষায় বিজ্ঞ বহু নবী-রাসুলকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, গাইডবুক হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন ১০৪টি ঐশীগ্রন্থ প্রত্যেক রাসুলের কওমের ভাষায়। প্রধান চার আসমানী গ্রন্থের তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ হয় হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম )এর উপর ইবরানী ভাষায়, যাবুর কিতাব হযরত দাউদ (আলাইহিস সালাম )এর উপর ইউনানী ভাষায়, ইনজিল কিতাব হযরত ঈসা (আলাইহিস সালাম )এর উপর সুরয়ানী (হিব্রু) ভাষায় এবং সর্বশেষ মহাগ্রন্থ কোরআন মাজিদ অবতীর্ণ হয় হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম )এর উপর আরবী ভাষায়। আর তাই মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- “আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষি করেই প্রেরণ করেছি, যেন তাদেরকে পরিষ্কারভাবে (আল্লাহর বিধানাবলি) বলে দেয়।” – সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৪
প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টিগতভাবে সমান। আর তাই জাতি, বর্ণ, গোত্র, বংশ নিয়ে গর্ব করার কিছুই নেই। এসব বিভক্তি শুধু পরস্পরের পরিচয়ের জন্য। বস্তুত আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা মর্যাদাশীল হওয়ার মানদন্ড ঈমান, সৎকর্ম ও পরহেযগারী। মহান আল্লাহ বলেন- “আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। বস্তুত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদাশীল ঐ ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পরহেযগার।”- সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
কিন্তু যুগে যুগে শাষকগোষ্ঠি নিজেদেরকে বাঙ্গালী জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলা হওয়া সত্তে¡ও অন্য ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার অপপ্রয়াস চালায়। সেন আমলে সর্বসাধারণের মুখের ভাষা বাংলার পথ রোধ করে মন্দিরের ভাষা সংস্কৃত চালানোর অপচেষ্টা চলেছিল। পরবর্তিতে মুসলমানদের শাসনামলে সে বাংলা ভাষাকে রাজ দরবারে এবং সাহিত্যাঙ্গনে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। বৃটিশ আমলে শত শত বছরের মুসলিম শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চেহারা বদলের শুধু প্রক্রিয়ায় চলেনি, বরং শেষ দিকে সাধারণ ভাষা নির্ধারণ প্রশ্নেও দেখা গেছে বুদ্ধিজীবি পর্যয়ের বিভক্তি। ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ভারতের সাধারণ ভাষা কী হবে প্রশ্নে যখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলার পক্ষে দাঁড়াই, তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে দেখা গেল হিন্দীর পক্ষে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে অনুষ্টিত ভারতের সাধারন সভা বিষয়ক সম্মিলনে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন,“সাহিত্যের শক্তির দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতের একটি মাত্র ভাষা সাধারণ ভাষার দাবী করিতে পারে। তাহা বাঙ্গলা ভাষা। আমি এ কথা বলি না যে,ভারতীয় কোন ভাষা সাহিত্য সম্পদ নয়। কিন্তু যে শক্তিতে এক ভাষা দেশে সাধারণ ভাষা হইতে পারে, সে শক্তি ভারতীয় আর কোন ভাষায় নাই। শুধু ভারতে কেন সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাঙ্গলা ভাষার স্থান হইবে সর্বোচ্চ।”
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জবাবে সভাপতির ভাষণে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন, “রাজনীতির ক্ষেত্র ব্যতিত অন্যান্য স্থানে আমাদের সাধারণ ভাষা যে ইংরেজী হইবে ইহা এক প্রকার ঠিক হইয়া গিয়াছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এতো দিন ইংরেজী চলিতেছিল। কিন্তু এখন একটা কথা উঠিয়েছে ভারতীয় কোন ভাষা চালাইতে পারা যায় কিনা এবং এই উপলক্ষ্যে হিন্দির নাম উঠিয়াছে।” তার উক্ত বক্তব্য প্রমাণ করে যে, তিনি মুলত ইংরেজীর পক্ষে এবং বিদেশী ভাষার পরিবর্তে ভারতীয় ভাষা দিতে হলে হিন্দিকেই পছন্দ করেন সাধারণ ভাষা হিসাবে, বাংলাকে নয়। অথচ এ বাংলা রবীন্দ্রনাথের মুখের ভাষা, সাহিত্যেও ভাষা এবং এ ভাষাটিই তাকে নোবেল বিজয়ী করেছিল, উপাধি দিয়েছিল বিশ্বকবি। ইতিপূর্বে ভারতের সাধারণ ভাষা কি হবে সে সম্পর্কে গান্ধীজির এক পত্রের জবাবে কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ভারতবর্ষের আন্ত:প্রাদেশিক ক্ষেত্রে ভাবের আদান প্রধানের উদ্দেশ্যে হিন্দিই একমাত্র সম্ভাব্য জাতীয় ভাষা। মুসলিম কবি আবদুল হাকিম এসব বাংলা বিদ্বেষীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-
যে সবে বঙ্গেত জম্মি, হিংসে বঙ্গবাণী – সে সব কাহার জম্ম নির্ণয় না জানি।
এভাবে যখন সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি হওয়ার জন্য হিন্দি বুিদ্ধজীবিদের চাপে সরলমনা বাঙ্গালীরা হিন্দির পক্ষে যাচ্ছিল ঠিক তখনই পাল্টা দাবী হিসাবে মুসলমানদের একটি পক্ষ উর্দুকে সমর্থন করে ক্ষোভ মেটাতে চায়। অথচ তখনও (১৯২১ খ্রী:) সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠান। তিনি শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষাকেই করতে হবে। রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত এ বিতর্ক চলে পরবর্তী ত্রিশ বছর পর্যন্ত। ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বিট্রিশ শাসনের অবসান ঘটল। দ্বিজাতিত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সুচনা ঘটে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতে রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবই বাস্তবায়ন হল। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হল হিন্দি। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো পাকিস্তানে। পাকিস্তানের তৎকালিন কর্ণধার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিম উদ্দীন ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকায় এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে দাবি করে। সাথে সাথে বাংলার জনগণ নো নো স্লোগানে ফিরিয়ে দিল তাদের সেই প্রস্তাব। শুরু হয় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাঙ্গণ উত্তপ্ত হল। ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দোলনের সূচনা হলেও সমগ্র দেশবাসী এর সমর্থন জানায়। আন্দোলনকারীদের উপর সরকারের যতই দমননীতি চলতে থাকে, ততই আন্দোলনের র্তীরতা বাড়তে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী, ৮ ফাল্গুন ঢাকায় পাক পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয় বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকেই । কবির ভাষায়-
মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল
ভাষা বাঁচার তরে
আজিকে স্মরিও তারে।
কোথায় বরকত কোথায় সালাম
যারা বাংলা কাঁদিয়া মরে
আজিকে স্মরিও তারে।
পরিণামে আতঙ্কিত সরকার ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। আজ যাঁদের রক্তের সিড়ি বেয়েই মাতৃভাষা বাংলা শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃত ; সে বীর ভাষা শহীদগণ রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী নন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর উত্তরসূরী মুসলিম বাঙ্গালী।
বাঙ্গালীর এই রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় সাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাই একুশ বাঙ্গালী জাতীর জীবনে উদ্বীপ্ত চেতনার প্রতীক। আর এ চেতনার ব্যাপ্তি আজ আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ২০০০ সাল থেকে এ দিবস সমগ্র বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে।
ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পর এখন একটাই দু:খ, যে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে সেই ভাষাকে চাপিয়ে ইংরেজী হয়ে ওঠেছে জনপ্রিয়। কেবল প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারী এলে যেমন শহীদ মিনারের ঘষামাজায় নিয়োজিত হয় কিছু শ্রমিক, তেমনি বাংলার সর্বাত্মক প্রচলনে ব্যর্থতার দায়ভার একে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে উৎসারিত হয় বিলাপ। অত:পর যথারীতি ইংরেজীতেই প্রায় সকল আনুষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তা অত্যন্ত লজ্জার এবং তা ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি জুলুম করার শামিল। আর তাই ইরশাদ হচ্ছে- তোমরা অন্যায়ভাবে কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করোনা, কারো উপর অত্যাচার ও জুলুম করো না, আল্লাহ জালিমদের পচ্ছন্দ করেন না।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা,খতিব,রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ।