একজন জেসমিন স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প
জেসমিন আক্তারের স্বপ্ন গ্রামে হত দরিদ্র নামক শব্দটি মুছে ফেলা
সুমন পল্লব, হাটহাজারী:: প্রাকৃতিক অপরুপ সুন্দর শ্যামলিমায় ঘেরা, সাগর ও বন্দর নগরী চট্রগ্রাম জেলার কাছেই হাটহাজারী পৌরসভার পাহাড়ের কোলঘেষে সন্দীপপাড়া গ্রামের দু’একজন নারী, যারা স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছেন জেছমিন আক্তার (৪৫) তাদেরই একজন। অনেক স্বপ্ন ছিল তার লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হবে। অল্প বয়সেই পারিবারিক চাপ ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল তাকে। স্বামীর অভাবী সংসারে এসেও সুখ পায়নি সে। তার স্বামী মোঃ মজিবুল (৫২) প্রতিদিন পাহাড়ের বাগানে গিয়ে লাকড়ি কুড়িয়ে এনে বাজারে বিক্রি করে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে সংসার চালাতো।
এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। শুনতে হয় না শশুর বাড়ির গালমন্দ। কারন এখন তিনিই অর্থের যোগান দিচ্ছেন এবং দারিদ্রকে জয় করেছেন। তাদের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য।
জেসমিন আক্তার এক সময়ে বাঁশ ও বেত দিয়ে নিজের হাতের তৈরী বিভিন্ন ধরনের মুরগীর খাঁচা, ডালা, মোড়া, কুলা এবং মৌসুম উপযোগী হরেক রকমের সামগ্রী তৈরী করতেন এবং এই গ্রামের ৪ জন হত দরিদ্র নারীকে এ কাজ শিখিয়ে তাদের উপার্জনের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন বেশ ভালই কাটছে তাদের জীবন।
জেসমিন আক্তার শৈশবকাল থেকেই হাতের কারুকার্য তৈরী করার প্রতি তার শখ ছিল প্রচুর বিধায় তার বাবা তাকে সাহায্য করেছিল। স্বামীর অভারী সংসারে এসেও নিজের পায়ে দাড়ানোর ইচ্ছা সব সময় তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। চিন্তা করতেন কিভাবে দু’পয়সা বাড়তি আয় করা যায়। সংসারে কোল জুড়ে আসে পর পর ৩টি ছেলে ও ১টি মেয়ে সন্তান। তাদেরকেও মানুষ করার দৃঢ় স্বপ্ন সব সময়ই দেখতেন।
১৯৯১ সালের ঘূর্নিঝড় লন্ডভন্ড করে পুরো এলাকাটি। তিনি অনেক ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের কথা শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কখনো দেখেনি সে প্রকৃতির তান্ডবলীলা। তার জীবনে দেখা সে দিনের তান্ডব। এমন ভয়াবহ দৃশ্য সে আর কখনো দেখেনি। ক্ষুধার্ত দানবের থাকায় তছনছ করে দিয়েছে এর জেসমিন আক্তার সামান্য মাথা গুজবার ঠাঁইটুকুও।
এরপর তার বাবা ও আতœীয় স্বজনের পরামর্শক্রমে স্থানীয় বাজার থেকে বাঁশ ও বেত কিনে এনে বাড়িতে বসেই হাত দিয়ে শুরু করেন বসার মোড়া তৈরীর কাজ। প্রথমে সপ্তাহে ২দিন স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করার সুযোগ করে দেন তার স্বামী। বিক্রিকৃত টাকা হাতে পেয়ে তার মধ্যে অনুপ্রেরনা ও সাহস যোগায়। শুরু হয় এগিয়ে চলা। নতুন নতুন স্বপ্ন উঁকি দেয় তার মনে। এ কাজে প্রথমে তার স্বামী সাড়া দেয়নি।
এরই ফাঁকে হাটহাজারী এডিপি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ তাকে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সাথে সংযোগ স্থাপন করে দেয় যাতে আয়বৃদ্ধিমুলক প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা পেতে পারে এবং এই গ্রামে প্রি-স্কুলসহ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে অসহায় শিশুদেরকে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
বিভিন্ন এনজিও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে ঋন দিয়ে আর্থিকভাবে এ কাজে সহায়তা করেছিল। বহু কষ্টে ৩ ছেলে ও মেয়েটিকে সংসারের অভাব অনটনের মধ্য দিয়েও মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে লেখাপড়ার দিকে মনোনিবেশ করিয়েছেন।
তার স্বামী মোঃ মজিবুল জানান, এক সময়ে সমাজে মাথা নিচু হয়ে থাকতে হতো। এখন সবাই ডেকে কথা বলে। তার স্ত্রীর গুনের কথা প্রসংশা করে ।
স্বামীর সংসারে এসে সুখের ছোয়া পায়নি সে। এ কাজের আগে বারো মাসই তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এখন তিন বেলা খাবার জুটছে। তিনি জানান যে, বসার জন্য মোড়া ও খাঁচা সামগ্রী তৈরিতে ৩০-৪০ টাকা খরচ করতে হয়, কিন্তু বিক্রি হয় ২০০ খেকে ২২০ টাকায়। বর্তমানে আয় হয় বেশ ভালই। তিনি জানান যে, উক্ত উপকরন সামগ্রী বিক্রিত টাকা যখন হাতে পাই তখনই খুব আনন্দ লাগে। সংসারের অভাব যে কিভাবে পালালো তার কোন টেরই পাইনি।
এই সাফল্যেও পথটি যিনি দেখিয়েছিলেন তার বাবা। তাকে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরন করেন।
সন্দীপ পাড়া গ্রাম উন্নয়ন কমিটি’র সভাপতি ওবায়েদুল্লাহ বলেন, জেসমিন আক্তার এর মধ্যে দুর দৃষ্টি রয়েছে বিধায় তার সফলতা আসছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে ২ জন ছেলেকে বিদেশে চাকুরীর জন্য পাঠিয়েছে আর ছোট ছেলে আরমান (২২) বর্তমানে ডিপ্লোমা কোর্সে পাওয়ার টেকনোলজিতে ৭ম সেমিষ্টারে অধ্যয়নরত। তিনি নিজেই স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে অন্যদেরকেও নিজের পায়ে দাড়াতে সহায়তা করেছেন।
জেসমিন আক্তারের স্বপ্ন! এক সময়ে এই গ্রামে হত দরিদ্র নামক শব্দটি মুছে ফেলা, যার মাধ্যমে তাদেরকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বাকি জীবনটা ব্যয় করার ইচ্ছা।