লেখক: মোহাম্মদ কামরুল হাসান: চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত রাউজান উপজেলার দরবারে চিকদাইর শরীফের প্রতিষ্ঠাতা পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) ছিলেন তাঁর উর্দ্ধতন পূর্ব-পুরুষ আরবের অধিবাসী হজরত সিরাজুদ্দীন বাগদাদী (রহঃ)’র বংশধর।
সম্মানিত পিতার নাম জনাব আব্দুল মোহিত পেশকার (রহঃ), দাদাজান জনাব হযরত শাহ্সুফী নাজিম উদ্দীন মুন্সী পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) হুজুর আপাদমস্তক শরীয়ত, সুন্নতের পাবন্ধী, সত্যবাদী, পরহেজগার, খোদা ভীরু ছিলেন, আপন শরীর আপাদমস্তক যেমন থাকত সুন্নাতি লেবাসে সজ্জিত, তেমনি চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে সুন্নাতে নববি ছিল তাঁর সকল কাজের মাপকাঠি।
সুন্নাতি লেবাসে এত সুন্দর আর কাউকে আমি দেখি নি। তাঁর চেহারা-সুরত, আচরণ-উচ্চারণ ও চাল-চলন সবকিছুই ছিল আকর্ষণীয়।উনার নূরানী চেহারা মোবারক নয়নযুগলকে পরিতৃপ্ত করে আর অন্তরকে মহানবী (সঃ) এর প্রেমভালবাসা ও আজমতের নূর দ্বারা কানায় কানায় ভরপুর করে দেয়।
হাদিসে আছে, “প্রত্যেক জিনিসকে পরিষ্কার করার বস্তু রয়েছে, দিলের ময়লা পরিষ্কার করার বস্তু হল জ্বিকির” (মেশকাত শরীফ)। সুতরাং কলবে জ্বিকির পয়দা করার মাধ্যমেই কলবকে পরিশুদ্ধ করা যায়। প্রত্যেক নামাজের শেষে সাধক মোরাকাবা অবস্থায় যার যে লতিফায় জ্বিকির বা ছবক তিনি তাতে খেয়াল করুন। গভীর ভাবে ডুবে যাবেন কলবের মধ্যে। আপন মোর্শেদের নূরানি চেহারা মোরাকাবায় সামনে নিয়ে গভীরভাবে আল্লাহকে স্বরণ করে তাঁর সাহায্য ভিক্ষা চাইতে হবে। এভাবে মোরাকাবা করতে করতে এমন একটা সময় আসবে যখন আপন মোর্শেদের নেক দৃষ্টি, দয়াল রসূল (স.)—এর মহব্বত ও আল্লাহপাকের অপার দয়ায় কলবে জ্বিকিরের ধ্বনি শোনা যাবে। এভাবে সাধনা ও এবাদত করতে করতে কলবে আল্লাহর জ্বিকিরের নকসা বসে যাবে।
প্রত্যেক লতিফা থেকে জ্বিকির শোনা যাবে। এমনকি কখনও কখনও সর্বশরীরে জ্বিকির হবে। জ্বিকিরের কম্পন জাহেরিতেও বুঝা যায়।তিনি চিকদাইর শরীফকে আল্লাহ ও রাসূলের পথে মানুষকে হেদায়াত এবং জিকিরের মারকাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমার মরহুমা দাদির কল্যানে সর্বপ্রথম আমার আরবি বর্ণমালার হাতেখড়ি হয় সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ)-এর হাতে।সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ)-এর পুরাতন বাড়িই আমাদের বাড়ি। সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ)-এর বড় নাতি আমার বন্ধু কুতুব উদ্দিন এর সাথে আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলি কেটেছিল।সেই সুবাদে হুজুরের পুরাতন বাড়ির হুজুরার পাশেই আমরা দু’জন প্রায়ই থাকতাম, দেখতাম সুফী সাহেব হুজুর (রহঃ)-এর কাছে প্রতিদিন মুসলিমগণ বহু দূর দূরান্ত থেকে হুজুরের হাতে বায়াতের জন্য আসতেন, হুজুর হাতের উপর হাত রেখে আবার কখনো লম্বা রুমাল দিয়ে তাঁর পবিত্র হাতে কাদেরিয়া-চিশতিয়া-নক্সবন্দিয়া-মোজাদ্দেদিয়া সহ বিভিন্ন ত্বরিকায় বায়আত করাতেন।
হুজুরের কাছে প্রতিদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শত শত মানুষ মাত্র দুই টাকার হাদিয়ায় তাবিজ-পানিপড়া নিতে আসা-যাওয়া করতেন।বহুবছর পরেও হুজুরের আদর্শ মেনে এখনো সেই দুই টাকা হাদিয়াই জারি রেখেছেন দরবার শরীফের সম্মানিত সাজ্জাদানশীন পীরে ত্বরিকত হযরত শাহ্সুফী মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকী (মা:জি:আ:) (পবিত্র বিলাদত শরীফ ১২ই মার্চ ১৯৪৬)।তিনি তাকওয়া – পরহেজগারীর মুর্তপ্রতিক তাঁর মেধা- মননশীলতা প্রসংসনীয়।মাজার শরীফ, মসজিদ, মাদ্রাসা সুশোভিত করে দরবারটিকে নান্দনিক রূপে সাজিয়েছেন।পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:), ‘পবিত্র ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম’, খাজা গরীবে নেওয়াজ (র:)-এর ইছালে ছওয়াব মাহফিল, ০৯ই এপ্রিল হজরত শাহ সুফী ছদর উদ্দিন আহমেদ (রহঃ)’র বার্ষিক ঈছালে ছওয়াব মাহফিল, ৩রা ডিসেম্বর পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) বার্ষিক ঈছালে ছওয়াব মাহফিল সহ ধর্মীয় প্রতিটি মাহফিলের আঞ্জাম দিচ্ছেন।
নিরলস পরিশ্রম করে ত্বরিকতের সবক, তালিম দিয়ে আসছেন।উনার রচিত “তাসাউফ দর্শন” বইটি ত্বরিকত পন্থী সকলের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি অমূল্য গ্রন্থ, ত্বরীকার বিস্তারিত মূলনীতি ও দর্শন এই কিতাবে রহিয়াছে। আল্লাহ উনাকে সুস্থ রাখুন, হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন।
পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) হুজুরের পাক মোবারক জবানের অত্যন্ত তাছির ছিল যখন যেভাবে বলেছেন তা হয়েছে, উনার অগণিত কারামত সন্দেহাতীত ও তর্কাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের অন্তর্গত একটি বিষয়। যা প্রকৃত অর্থে কুদরতে ইলাহীর বহিঃপ্রকাশ, কলেবর বৃদ্ধির কারণে উল্লেখ করছি না। তবুও একটি বিষয় জানা খুব প্রয়োজন তখনও চিকদাইর গ্রামটি চিকদাইর শরীফ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়নি অথচ তার বহুপূর্বে সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ)’র নাতি আমার চাচ্চু জনাব এহসানুল হক (মাসুদ)কে পরপর তিনবার চিকদাইর শরীফ নাম উচ্চারণ করতে বলেছিলেন।উনার পীর সাহেব হজরত শাহসুফী সদর উদ্দিন সাহেব (রহঃ) হুজুরকে বলেছিলেন বাবা আতরের মুখ বন্ধ রাখবেন যাতে সুগন্ধি বের না হয়।
আল্লাহ কি অপার মহিমা, উনি না চাইলেও উনার বহু কারামত, মহামূল্যবান মলফুজাত দ্বীন ও ত্বরিকতের কল্যাণে গোপনে বাহ্যিকভাবে ঠিকই সুগন্ধীতে মোহিত হুজুরের বাণী সত্যি হয়েছে, আমার প্রিয় গ্রামটি এখন চিকদাইর শরীফ নামে পরিচিত।
বায়াত গ্রহণ:-
আধ্যাত্মিকতার প্রাণপুরুষ, সর্বজন মান্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) ছিলেন হজরত শাহ সুফী সদর উদ্দীন আহমদ (রহঃ)’র প্রধান খলিফা।নিজ সাধনা বলে স্বীয় পীর হইতে কাদেরিয়া-চিশতিয়া-নক্সবন্দিয়া-মোজাদ্দেদিয়া-মোহাম্মদীয়া ত্বরিকায় কামালিয়াত হাছেল করেন।মায়ানমার (বার্মা)’র রেঙ্গুনের মূল শহরের সুল প্যাগুদা রোড়ে অবস্থিত মুসলমানদের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে পরিচিত প্রার্থনার পবিত্র স্থান “বাঙালি সুন্নী জামে মসজিদ”। যেখানে হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী (রাঃ), হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাঃ), হজরত শাহ সুফী সদর উদ্দীন আহমদ (রহঃ)’র মত বিখ্যাত বুজুর্গরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন।সরকারি চাকুরীর কারণে পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) তখন মায়ানমার (বার্মা)’র রেঙ্গুনে অবস্থান করছিলেন এবং এমন একজন কামেল পীরের সন্ধান করছিলেন যাঁর আকর্ষণী শক্তির মাধ্যমে অন্তরচক্ষু খুলে দিতে পারেন। আল্লাহ যখন কাউকে তার প্রিয় বান্দা রূপে পেতে চায় তখন তাঁর হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করেন।হঠাৎ একদিন ঐ মসজিদে আসলেন হজরত শাহ সুফী সদর উদ্দীন আহমদ (রহঃ), পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই দু’জন মুখোমুখি হলেন চার চোখ এক হয়ে যায়, এক সাধক কবি বলেছেন, ‘আশেকের ভেদ মাশুক বোঝে, যে যার পীরিতে মজে’ তিনি সেদিনই হজরত শাহ সুফী সদর উদ্দীন আহমদ (রহঃ)’র পবিত্র হাতে বায়াত হয়ে যান, দিনটিকে আল্লাহ আশেক-মাসুকের এশকে হাকীকিতে পরিণত করে দিলেন।শুরু হল কঠোর ইবাদত ও রিয়াজতের, তিনি এমন কঠোর সাধনায় মগ্ন হলেন নিজেকে ফানা করে দিয়ে আপন দিলকে সমস্ত দিক হতে ফিরিয়ে আল্লাহর মহব্বতে ডুবে গেলেন।প্রেমময়কে পাইতে প্রেমাগ্নিতে আপনাকে আত্মাহুতি দিতে পীর সাহেবের নির্দেশনায় কঠিন রিয়াজত সাধনায় দীর্ঘদিন পাহাড়,পর্বত, বন, জঙ্গলে, বৃষ্টিজলে, রোদে পুড়েছেন।অবশেষে আল্লাহ সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ)”ফানা ও বাকা” উভয় পর্যায়ের মর্যদা দান করার পর পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ)-এর পীর সাহেব ফুরফুরা শরীফের প্রধান খলিফা হযরত শাহ ছুফি ছদর উদ্দিন আহমদ আশ-শহীদ (রহ:) নিজে এসে সুফী সাহেব হুজুর বাবাজান (রহঃ) কে চিকদাইর শরীফে গদিনশীন করে আমাদের সৌভাগ্যের আলোয় প্রজ্জলিত করেছেন।
হুজুরের পবিত্র ওফাত দিবস :
(১৪১৭ হিজরী, ২০শে রজব, ১৪০৩ বাংলা, ১৯শে অগ্রহায়ণ, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৯৬ইংরেজী, রোজ: সোমবার।)
পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) চট্টগ্রাম গোলপাহাড়স্থ ইউনুস ম্যানসনে জিকিররত অবস্থায় ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।চিকদাইর শরীফ মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী চিকদাইর উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন বিশাল খালি ময়দানে যতদূর চোখ যায় হাজার হাজার মানুষ হুজুরের জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করেন এত বড় জানাজা আমি দ্বিতীয়টি আর দেখিনি।প্রতি বৎসর ০৩রা ডিসেম্বর, ১৯ অগ্রহায়ণ হুজুর কেবলার ওফাত দিবসটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য্য পরিবেশের মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
ফুরফুরা শরীফ এর সাথে চিকদাইর শরীফের সম্পর্ক :-
১) ফুরফুরা দরবার শরীফ এর প্রতিষ্ঠাতা মোজাদ্দেদে জামান হযরত শাহ্সুফী মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকী আল কুরাইশী (রাহঃ)’র
প্রধান খলিফা
২) হজরত শাহ সুফী ছদর উদ্দিন আহমেদ (রহঃ)’র
প্রধান খলিফা
৩) পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ)
আমার শক্তি “আমার আবেগ”, আবার সে আবেগ-ই আমার বিশেষ দুর্বলতা।আর সেই বিশেষ দুর্বলতার জায়গা হল চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার অন্তর্গত চিকদাইর শরীফের প্রতিষ্ঠাতা আমার সুফী সাহেব হুজুর (রহঃ)।যাঁর অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে জীবনে প্রত্যাশিত শান্তি ও সফলতার বাতিঘর প্রজ্বলিত রাখার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রতিনিয়ত ফরিয়াদ করি।আল্লাহ আমার আর্জি ফরিয়াদ কবুল করুন।পীরে কামেল হযরত শাহ্সুফি নুরুল হক (রহঃ) প্রকাশ চিকদাইর সুফী সাহেব হুজুর (রহঃ)’র সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপাথ্য সংগ্রহ করে লেখা আমার মত অধমের পক্ষে দুঃসাহস ছাড়া আর কিছু নয়।প্রতি মূহুর্ত ভয়ে কাটে, মনে হয় কিছু ভুল হয়ে গেল। সম্মানিত সকলের প্রতি আমার ভুল-ত্রুটি ক্ষমার অনুরোধ করছি।