মতামত

ঈদ হোক সবার জন্য

হাফিজুল ইসলাম লস্কর:: ঈদ’ শব্দের আরবি শব্দমূল ‘আউদ’। ঈদ অর্থ যা ফিরে ফিরে আসে। মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম হচ্ছে “ঈদ-উল- আযহা”। যা বড় ঈদ বা কোরবানীর ঈদ নামে খ্যাত।

কোরবানী শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, নিজেকে বিসর্জন, নৈকট্য লাভের চেষ্টা ইত্যাদি।

ইসলামী পরিভাষায় কোরবানি হলো- নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরই নামে জবেহ করা।

মক্কা নগরীর মিনা প্রান্তরে আল্লাহর দুই নিবেদিত বান্দা ইব্রাহীম ও ঈসমাইল (আ:) মহান আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন সেটিরই স্মৃতিচারণ হচ্ছে এই ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানীর ঈদ। ইসলামের এক মহান নিদর্শন এই কোরবানী যা “সুন্নতে ইব্রাহীম” হিসেবে মহানবী (সাঃ) প্রতিবছর মদিনায় পালন করতেন। পরবর্তী সময়ে সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে এটি পালন করেছেন।

ঈদ আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীর ঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ত্যাগ ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামগ্রিক কল্যাণের বার্তা নিয়ে। ঈদ আসে কৃচ্ছ্র ও শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার (আল্লাহভীতি) শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে ঈদ আসে।

ঈদ আনন্দ, মৈত্রী, সাম্য, সম্প্রীতি ও ত্যাগের অপার শিক্ষা নিয়ে আমাদের মাঝে সমাগত হয়। ঈদ ঘরে ঘরে আনন্দ আর খুশীর শিহরণ জাগায় ছোট, বড়, ধনী, গরীব সকলের অন্তরে। এদিন হিংসা-বিদ্বেষ, সকল ভেদাভেদ ভুলে আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে মানুষের অন্তরআত্মা বিকশিত হয় এক ঐশ্বরিক আলোয়। এ আলোর বিকিরন ছড়িয়ে পরে মুসলিম সমাজের গন্ডি পেরিয়ে সর্বত্র। পৃথিবীর আনাচে কানাচে বিঘোষিত হয়ে ওঠে ঈদের জাগরণী উচ্ছ্বাস। কোরবানির দীক্ষা জাগুরুক হয়ে উঠে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনে।

মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কুরবানীর সাথে সাথে মনের পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে আত্মত্যাগের শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি ঘরে ঘরে।

ঈদ উল আযহার ছোঁয়ায় ত্যাগ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানবিক চেতনা জাগ্রত হয়ে ওঠুক। ঈদ প্রতিবছর আসে শিক্ষণীয় জীবনের বার্তা নিয়ে। বিশেষ করে সুখ, সৌহার্দ্য আর আনন্দের বার্তা নিয়ে। এই পবিত্র উৎসবে ধনী-দরিদ্র, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সব মুসলমান মিলেমিশে ঈদের আনন্দ সমভাগ করে নেন, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার ভুলে খুশিমনে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। কোরবানীর আদর্শ এসব অনুভুতিতেই লুকিয়ে আছে।

অনাবিল শান্তি ও অবারিত আনন্দের বার্তা নিয়ে ঈদের এক ফালি চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে ভেসে ওঠে, তখন সর্বশ্রেণির মানুষের হৃদয়-গহিনে বয়ে যায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মৃদু দোলা। ঈদ বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় নেয়ামত। অফুরন্ত কল্যাণের আরক ছড়িয়ে আসে ঈদ। ঈদ আসে শত্রুতা ও দ্বেষের প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুত্ব ও মিতালির হাত বাড়িয়ে। ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবের আবেশে মনকে মথিত করতে। পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া ও ‘আবে হায়াত’র স্নিগ্ধতা দিতে।

ঈদ উল আযহা মুসলমানদের জন্য একই সঙ্গে ত্যাগ, আনন্দোৎসব এবং ইবাদত। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ ত্যাগ শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা নেই। এ আনন্দে কেবলই সওয়াব ও পুণ্যের দ্যূতি। এ আলোক-দ্যূতি ও আনন্দ ক্রমান্বয়ে সঞ্চারিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে।

শিশু-কিশোর ও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা-সবার দেহ-মানসে দোলা দেয় ঈদ-আনন্দের ছোঁয়া। আমাদের ত্যাগ, সামান্য সহযোগিতা এবং কিছু টাকা, কিছু নতুন কাপড় এবং কোরবানীর গোশত পেয়ে হতদরিদ্র, এতিম-দুস্থ, নিঃস্ব-অসহায় ও বেশুমার ছিন্নমূল মানুষের মুখে ফোটে হাসির রেখা। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীরাও এ আনন্দে মেতে ওঠেন সমান রূপে। ঈদ উপলক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তারাও ভোগ করেন। আর এভাবেই ঈদ সর্বজনীন ও সবার হয়ে ওঠে।

সুখবর পেলেই মানুষ আনন্দিত হয়। আর আর্থিক ত্যাগ ও মনের পশুত্বের বিসর্জনের মাধ্য দিয়ে মনের অহমিকা ছেড়ে গরীব ধনী সবাই মিলেমিশে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যেই ঈদ উল আযহার সার্থকতা ফুটে উঠে।

মুমিনের ঈদ-আনন্দ উত্তম পোশাক গায়ে দেওয়া, ঈদের দিন সকলে মিলেমিশে নামাজ আদায় করার মাধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং অসীম ত্যাগের নির্দশন কোরবানী আদায় করা। গরিব-দুস্থ ও অসহায়ের সহযোগিতা-সেবা, অন্যের মুখে হাসি ফোটানো পরিপূর্ণ চেষ্টা করা।

অসামান্য ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল ঈদ-উল-আযহা। এমন ত্যাগের দৃষ্টান্ত সৃজন বিশ্বে দ্বিতীয়টি আর নেই। মানব মহত্বের, মহত্তম জীবন বোধের এক অনতিক্রম্য স্মারক। অতএব, কামনা করি এই বোধ ও বোধের আলোক প্রক্ষেপনে নিরন্তর ধারায় আনন্দময় হয়ে উঠকু মানবভূমি।

পশু কোরবানির সাথে সাথে নিজেদের মধ্যকার পশুত্বকেও কোরবানের মাধ্যমে এবং সকলের মাঝে খুশির ভাগাভাগি করে আমরা অর্জন করতে চাই আল্লাহর সন্তুষ্টি। প্রকৃত ত্যাগের শিক্ষাতেই কোরবানি ঈদ এর মূল তাৎপর্য। ঈদ সমপ্রীতি, ভালোবাসার বন্ধনে একে অপরকে নতুন করে আবদ্ধ করে নেয়ার দিন। তাই ঈদের আনন্দ বিরাজ করে বেশ কয়েকদিন আগ থেকে। আর এ রেশ থেকে যায় ঈদের কয়েকদিন পর্যন্ত। মানুষ মানুষের জন্য, এই চিরসত্য নীতিতে সাম্য ও ঐক্যের ভিত্তি রচনা করতে হবে সুন্দর পৃথিবী তৈরী করার জন্য। অতীতের দুঃখ দুর্দশা ছুঁড়ে ফেলে সমস্ত ভেদাভেদ দূর করে ছোট-বড়, গরিব-ধনী সবার সঙ্গে মিলে মিশে জানান দেই-আমরা এক আল্লাহর সৃষ্টি। মানব কল্যাণ আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য।

মানবিক কল্যাণ সাধনই হোক ঈদুল আযহার প্রত্যয়। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে, প্রসারিত হোক সপ্নীল সুন্দর ভবিষ্যৎ। নৈতিক মূল্যবোধ ও দৃঢ়তায় বলীয়ান হয়ে মানবিক কল্যাণ সাধনই হোক আমাদের প্রত্যয় ও দূর হোক সকল প্রকার বৈষম্য। পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার ভুলে সুদৃঢ় হউক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

ঈদ-উল-আযহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাৎ কু-প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা। আমাদের এই ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের মনের যাবতীয় ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রী কাতরতা দূর করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ তথা বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

লেখক, হাফিজুল ইসলাম লস্কর,
সম্পাদকঃ সাপ্তাহিক ইউনানী কন্ঠ।
স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদকঃ বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি।
স্থায়ী সদস্যঃ বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ক্লাব।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button