জীবন গঠনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ
মো: জিল্লুর রহমান:: বর্তমান সময়টি ফেসবুক, ইন্টারনেটের। এ যুগে নিজেদের চরিত্র ঠিক রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে। বর্তমানে পরিবার ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চরিত্রহীনতার দিকটি বিশেষভাবে ফুটে উঠে। ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, মাদকের ছোবল ইত্যাদি সমাজকে কলুষিত করে তুলেছে। অনেকে বলছেন পিতা মাতার সঠিক তত্ত্বাবধান, নৈতিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। যা একদিকে যেমন অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা, ঠিক তেমনিভাবে কোন ক্রমেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করেন। পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন পরিপালনে পিতা মাতার ভূমিকা ব্যাপক। পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসা দরকার। কেবল মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম।
বহু মা-বাবা, অভিভাবক আছেন সন্তানের জন্য অনেক কিছু করেন। কিন্তু তাদের সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকটিকে একেবারে উপেক্ষা করে যান। মোটেও গুরুত্ব দেন না। গতানুগতিক ও আধুনিকতার কথা বলে ধর্মকে কাছে ঘেঁষতে দেন না! ফলে এর প্রভাব পড়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি বাঁকে। চরিত্র বিধ্বংসী সব কাজকে তারা আগলে নেয়। জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে। চরিত্র গঠনের জন্য তাই আমাদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা দরকার। ব্যবহারিক জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে খুবই জরুরি। এ জন্য চরিত্র গঠনে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ ও যুবসমাজকে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। যা অসুন্দর, দৃষ্টিকটু বা রুচিহীন, সে সবকে ইসলাম বা কোন ধর্ম কখনো সমর্থন করে না। বরং সেগুলোকে বর্জন করতে উৎসাহী করে তোলে। মানুষকে পরিপূর্ণরূপে চরিত্রবান করে তুলতে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো বিকল্প নেই।
আসলে বর্তমান সমাজে পরিবারের দায়িত্ববোধ কমে যাওয়ায় এবং এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখায় এর প্রতি সদস্যদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাবা-মা-ভাই-বোন কেউই কারো প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা যথাযথ দায়িত্ববোধ অনুভব করছে না। বস্তুবাদী এ সমাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বাবা মা উভয়েই চাকুরী ও অর্থের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছে না। ফলে ছেলেমেয়েরা অভিভাবক বা বড়দের পরোয়া করছে না। সামান্য ব্যাপারেই পরিবার ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ছেলে মেয়েরা সেগুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করছে এবং পরবর্তীতে এগুলো তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব ও মানবতা বোধের পরিচয় দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবার থেকে পাচ্ছেনা মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা। বাবা মা উভয়েই চাকুরীজীবি হওয়ায় তারা অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও সন্তানের সুশিক্ষায় নজর দিতে পারছে না। ফলে সন্তানরা গৃহশিক্ষক কিংবা গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে থেকে নৈতিক মূল্যবোধ তথা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেকের সন্তান বিপথে চলে যাচ্ছে। যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে।
সন্তান প্রতিপালন আজকাল মা-বাবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সন্তানকে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আজকাল ছেলেমেয়েরা একটু বেশি স্বাধীনতা চায়, আর তারা একটু বেশি সংবেদনশীল। তাই খুব সহজেই ঘটে যায় নানা বিপত্তি। আসলে একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হচ্ছে তার পরিবার। বড় হয়ে সে যে পরিবেশেই শিক্ষা নিতে যাক কেন পারিবারিক শিক্ষার একটা প্রভাব তার মধ্যে সবসময় পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক মা বাবারই সন্তান প্রতিপালনে কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত।
মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। সন্তানকে মাঝেমধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হয়। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে অনেক পরিবারের অভিভাবক পিতা মাতা উভয়ই নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকে। ফলে তাদের কাছ থেকে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য তা থেকে সে হয় বঞ্চিত। তাই কার্টুন ছবি দেখে আর মোবাইল-গেম খেলে শিশু সময় কাটায়। এতে তার মস্তিষ্ক ধারণ করে যতসব উদ্ভট চিন্তা।
একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হল পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা- এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।
সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিভূমি। পরিবারই সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষার সূচনা। পরিবারকে সমাজ দেহের হার্টের সাথে তুলনা করা চলে। এই হার্ট যদি দুর্বল বা বিকল হয়ে পড়ে তাহলে পুরো সমাজ ব্যবস্থাই বিকল হয়ে যাবে। সমাজ জীবনের মূল্যবোধের যত অবক্ষয় ঘটেছে তার অধিকাংশেরই কারণ বিশ্লেষণে দুর্বল পারিবারিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। পরিবার শিশুর প্রাথমিক ও নৈতিক শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। এখান থেকেই তার চরিত্রের ভিত্তি গড়ে উঠে। তাই পরিবারে মা-বাবার প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে সন্তানকে শৈশব থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
বাবা-মা’কে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হয়। তাহলে সন্তান সবকিছুই বাবা-মা’র সঙ্গে শেয়ার করবে। যে সন্তান শেয়ার করতে শিখে সে কখনও আদর্শহীন হয় না। ঘরের পরিবেশ ভালো হলেই যে সন্তান সভ্য-ভদ্র ও আদর্শবান হবে তা ঠিক নয়। সন্তান কাদের সঙ্গে মেশে, বন্ধুত্ব করে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়। মোটামুটি পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই শিশুর মধ্যে নিজস্ব সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়। ছোট থেকেই সন্তানের সামনে সুশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা এবং তার মধ্যে তা চর্চার প্রচলন ঘটাতে হয়। শিক্ষিত হওয়ার জন্য যেমন একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি সন্তানকে সুস্থ মানসিকতার ধারক-বাহক করার জন্য সভ্যতা-ভদ্রতা-নৈতিকতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো মননের অধিকারী করে গড়ে তুলতে হয়। মোদ্দা কথা, বিচক্ষণ বাবা-মা বা অভিভাবকদের সন্তানরাই সমাজে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। আদর্শ পরিবারের সন্তান সুসন্তান হবে এটাই স্বাভাবিক।
সন্তানের পরিচর্যার দু’টি দিক রয়েছে। এক. শারীরিক পরিচর্যা, অর্থাৎ উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে যত্ন নেয়া। দুই. মানসিক পরিচর্যা, অর্থাৎ শিশুর দৈহিক সুস্বাস্থের পাশাপাশি তার মানসিক পরিপক্বতা বৃদ্ধি করা, তার মনমানস ও চরিত্র গঠনে চেষ্টা করা, দৈহিক খাদ্যের পাশাপাশি তাকে উন্নত চিন্তার খোরাক দেয়া। আমরা আমাদের সন্তানকে কত কিছু শেখাই! তাদের পেছনে কত শ্রম ব্যয় করি! কিন্তু আমাদের সন্তানেরা দেশ-বিদেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করে। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক সুশিক্ষা দেওয়া হয় না। অনেক পরিবারে তো ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে রীতিমতো বিরূপ ধারণা দেয়া হয় এবং সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা হয়। যার ফলে আমাদের সন্তানেরা নৈতিক শিক্ষা থেকে সব সময়ই বঞ্চিত থাকে। বড় হয়ে তারা অনৈতিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। শিশুর প্রথম পাঠশালা হলো তার পরিবার। বাবা-মা হলেন তার প্রথম শিক্ষক। বাবা-মায়ের চলন-বলন, কাজ কর্ম হলো তার পাঠ্যবিষয়। তবে শিশুর নৈতিকতা বিকাশে বাবার চেয়ে মায়ের ভূমিকাই বেশি। কারণ শিশুরা বাবার চেয়ে মায়ের সান্নিধ্য বেশি পায়। তাই পিতা মাতার সুশিক্ষাই উপহার দিতে পারে আদর্শ সন্তান। সন্তানের বাবা-মা যদি সুশিক্ষা ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাকে গড়ে তুলতে পারে, তবে তার মধ্যে অনুপম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। সে হয় একজন আলোকিত মানুষ। পৃথিবীর এই মানব সমাজে সে ফুল ফোটায়, আলো ছড়ায়।
তবে ধর্মীয় বিধিবিধানকে মেনে চলতে পারলে চরিত্রকে সুন্দর করে তোলা কঠিন হয় না। অনেকে আছে যারা ধর্মের কথা শুনলেই অস্বস্তিতে ভোগেন, নাক ছিটকান। অথচ পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনই পারে মানুষের চরিত্রকে আলাদাভাবে প্রকাশ করতে, যোগ্য করে গড়ে তুলতে। নিজের পরিবার ও সমাজে সুশিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে তরুণদের চরিত্র গঠন আরো সহজ হবে। পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশের অভাবে যারা বিপথগামী ও দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সেটা রোধ করা অনেক সহজ হয়।
লেখক, মো: জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার।