শক্তিধর দেশগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও নিরাপদ বিশ্ব
মো: জিল্লুর রহমান:: বর্তমান বিশ্বে শক্তিধর দেশগুলো মারাত্মক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হিরোসিমা-নাগাসাকি পৃথিবীর মানুষের কাছে নৃশংসতম বর্বরতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসাবে বছরের পর বছর ধরে চিত্রিত হয়ে আসছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির নাম শুনলেই ভয়ে আতঙ্কে ওঠে শান্তিপ্রিয় মানুষের মন। অথচ এর চির অবসান হওয়া দরকার। এ জন্য প্রয়োজন সকল দেশের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ পারমাণবিক অস্ত্রের বিশাল মজুদ গড়ে তুলবে, পৃথিবীকে তটস্ত রাখবে আর কেউ এর অধিকারী ও হতো পারবে না তা তো কোন আইন হতে পারে না।
সামরিক খাতে নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন বিশ্বের অনেক দেশের প্রবণতা। প্রত্যেকেই যে যার মতো নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। এক্ষেত্রে কোনো দেশ পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। অবশ্য প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। সেই অধিকার থেকেই তারা নিজেকে সুরক্ষার চেষ্টা করে। দুর্বল বা সবল কোনো দেশ এক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রয়োজনে মিত্র দেশের সাথে জোটভূক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষার কথা তারা চিন্তা করে। দেশগুলো নিজেদের ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশ এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার পেছনে ব্যয় করে। অনেক দেশ আছে যাদের সামরিক খাতে ব্যয় অনেক বেশি।
যদিও যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছে, অন্যদিকে ওই একই মুখে উচ্চারিত হচ্ছে চিরাচরিত শান্তির বুলি! মানুষ আসলে কি চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। এশিয়ায় শক্তিমত্তা বাড়িয়ে চলেছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া। দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ ও টহলের পরিমাণ বাড়িয়ে এরই মধ্যে চীন তাদের সামরিক অগ্রগতির প্রমাণ জানান দিয়েছে। কমিউনিস্ট শাসনের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনে বৃহৎ সামরিক প্রদর্শনীর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বিষয়টি চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পেশিশক্তি নয় বরং এক্ষেত্রে দায়বদ্ধ চীনকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভারত, চীন, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া সবাই সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার প্রতিবেদনে সামরিক শক্তিতে কার কী অবস্থান এ বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত ও ফ্রান্স প্রথম পাঁচে অবস্থান করছে। পাকিস্তানের অবস্থান ১৭। এ অঞ্চলের দেশগুলো হঠাৎ করেই সামরিক শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান। ফলে আমাদের হাতেও বিকল্প নেই। নিজেকে রক্ষার জন্যই এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বিশ্বকে নিরাপদ করতে কতটা সক্ষম হবে, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায় বিশ্বে অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে এক নম্বরে অামেরিকা, দ্বিতীয় রাশিয়া ও তৃতীয় ফ্রান্স। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় অামেরিকা থেকে। আর অামেরিকা যে অস্ত্র বিক্রি করে, তার অর্ধেক কেনে মধ্যপ্রাচ্য। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপরি) এর এক তথ্যে দেখা যায়, অামেরিকা ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যা অস্ত্র বিক্রি করত, এখন তার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি করে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বে মোট যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৩৭ শতাংশ করেছে অামেরিকা। তারা মোট ৯৬টি দেশকে অস্ত্র বিক্রি করেছে। আর তাদের অস্ত্রের সব চেয়ে বড় ক্রেতা হলো মধ্যপ্রাচ্য। অামেরিকার অর্ধেক অস্ত্রই যায় সেখানে। আর মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে সৌদি আরব এবং সাম্প্রতিক সময়ে সোদি আরব সেই অস্ত্র ইমেয়েনে আগ্রাসন চালাতে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। বস্তুত তারাই বিশ্বের সব চেয়ে বড় অস্ত্রের ক্রেতা।
তবে ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি। তার আগের এক দশক ধরে অবশ্য অস্ত্র বিক্রি সমানে বেড়েছে। এর মূল কারণ, চীন ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা কমেছে। রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ কম হওয়ার কারণ, ভারত সে দেশ থেকে অনেক কম অস্ত্র কিনছে এবং নিজেরাই অনেক অস্ত্র উৎপাদন করেছে। ফলে অামেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি থেকে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়লেও সামগ্রিকভাবে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বাড়েনি।
নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বা অন্যকে ভয় দেখানো যদি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। পৃথিবীর অস্তিত্ব যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে নিজেকে সুরক্ষিত করার কোনো অর্থ হয় না। আজকের যে আক্রমণাত্মক প্রবণতা তা অতীতেও ছিল। তখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো, উলুখাগড়ার প্রাণ যেত। তারাও তাদের শক্তি জানান দিতে অন্যদেশ আক্রমণ করত। যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল বের করত। নতুন নতুন অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করত। সে সময়ও ছোট ছোট রাজ্যগুলো একজোট হয়ে বড় রাজ্যকে প্রতিহত করত। সেই কৌশলের আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে শুধু অস্ত্রের। যুক্ত হয়েছে আরো বেশি মরণঘাতি অস্ত্র। মানুষের এ হঠকারী কাজ পৃথিবীর কতটুকু উপকারে আসছে সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন। যে শ্রম, অর্থ কাজে লাগিয়ে মানুষ বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন করেছে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তা অবিশ্বাস্য। এজন্য মানবতা পায়ে দলতেও তারা কুণ্ঠিত হয়নি। আজ বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যদি আর কোনো বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে এই পৃথিবী নামক গ্রহ টিকবে কি না সন্দেহ। অস্ত্র প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্যই হলো স্থল, আকাশ ও নৌপথে নিজের দেশকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখা। নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা। অন্য দেশের ওপর খবরদারি করা। এসব মানব জাতির জন্য হুমকি হলেও সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ ভাবছেন না অস্ত্র প্রতিযোগিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। নিজেকে রক্ষার এই কৌশল একদিন বুমেরাং হবে।
তবে, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রগুলোর যে চরিত্র ছিল এখন বাস্তবতই তা অনেকটা পাল্টে গেছে। আগে রাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেহারা ছিল আন্তরাষ্ট্রীয়, এখন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের সংঘাত। বর্তমানে এমন সংঘাতের চেহারা পাল্টে গেছে বা বলা চলে নতুন রূপ পেয়েছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়েছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংঘাত। বাইরের রাষ্ট্র এসে আক্রমণ করছে না। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজের ভেতরেই যে সংঘাত, দ্বন্দ্ব তাই তাকে সামগ্রিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। যেমন কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, সুদান ছাড়াও আরো কিছু নতুন দেশ যেমন ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের ঘটনা। বর্তমানে সব দেশই অন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতে ভুগছে। ফলে আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাতের চেয়ে এখন অন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাত তীব্র হচ্ছে। রূপান্তর ঘটেছে, বদলে যাচ্ছে সংঘাত ও সংগ্রামের চিত্র।
পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ মৌলিক অধিকার ও সুবিধা থেকে এসব মানুষ বঞ্চিত। অথচ মানব জাতিকে ধ্বংসের জন্য উন্নত দেশসমূহ মরণাস্ত্র তৈরির পিছনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এসব না করে উন্নত দেশের নেতৃবৃন্দ আজ যদি তাদের সময়, শ্রম এবং অর্থকে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মরণব্যাধি এইডস, জলবায়ুর উষ্ণতা রোধ এবং করোনা মহামারী নির্মূলের জন্য ব্যয় করত তাহলেই বরং বিশ্ববাসী উপকৃত হত এবং শান্তি পেত। মরণাস্ত্র তৈরীর জন্য যেই বাজেট ব্যয় হচ্ছে, সেই বাজেটের সিকি ভাগও যদি আজ মানব জাতির জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ব্যয় হত তাহলে পৃথিবী আজ ক্ষুধা এবং দারিদ্রতা মুক্ত হত। আর এটাই হত সত্যিকার অর্থে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চা।
ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মধ্যে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমার কথা বলা হয়। প্রতিটি অস্ত্রই মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। যুদ্ধাংদেহি মনোভাব নিজেদের ভেতর জিইয়ে রেখে আমরা যে মারাত্মক বোকামি করছি তা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, অস্ত্রের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া। একটা স্বাভাবিক পৃথিবী ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ করতে হবে। যে পৃথিবীতে কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা বসবাস করছি। অস্ত্র উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যদি মানুষ হত্যার (অস্ত্র কেনা) বাজেট হ্রাস করি তবেই গবেষণা ও প্রস্তুতির জন্য তহবিল থাকবে। এত চমৎকার একটা সত্য বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরার পরেও তাদের মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে কি? হয়ত না। কারণ যুগ যুগ ধরে চলে আসা ক্ষমতাকেন্দ্রীক মনোভাব এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হবে না। ফলে খুব তাড়াতাড়ি বিশ্ব হুমকি মুক্ত হবে এটাও আশা করা ঠিক হবে না। তাহলে বিশ্বের পরিণতি কী? আমরা কি নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলব? এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে এবং এক্ষেত্রে শক্তিধর দেশগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোন ক্রমেই নিরাপদ বিশ্বের জন্য সহায়ক নয়।
লেখক, মো: জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার।