মতামত

মস্তিষ্কের শক্তি বাড়বে কিসে? মেমোরি কার্ডে!

ফজলুর রহমান::

“ মস্তিষ্ক এমন একটি পৃথিবী যা অনেকগুলি অনাবিষ্কৃত মহাদেশ এবং অজানা অঞ্চলের বিস্তৃত অংশ নিয়ে গঠিত।”- সান্তিয়াগো রামন। “স্মৃতি হচ্ছে সকল প্রজ্ঞার জননী” (Memory is the mother of all wisdom) -ইস্কিলুস (Aeschylus). মস্তিষ্কের শক্তির কাছে পৃথিবীর কোন কিছুই অসম্ভব নয়। পুরো বিশ্বকে মস্তিষ্কের জ্ঞান দ্বারা বদলে দেয়া যায়। বলা হয়, দুর্বল মস্তিষ্ক বা জ্ঞানহীন ব্যক্তি পশুর সমান। তাই মানুষকে এমন কিছু প্রদর্শন করতে হয়, যা মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী করতে পারে না। মস্তিষ্ক আমাদের দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের দেহ এবং মন পরিচালনার মূল কেন্দ্র হচ্ছে মস্তিষ্ক। মস্তিকে রাখা থাকে আমাদের সমস্ত স্মৃতি। মস্তিষ্ক আমাদের বুদ্ধিমত্তার উৎস। আমাদের মস্তিষ্কের সঠিকভাবে কাজ করা প্রয়োজন। মস্তিষ্ক যদি এক মুহূর্তের জন্য হরতাল ডাকে, যদি মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের মারাত্মক বিপজ্জনক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। মস্তিষ্ক গবেষকরা মনে করেন, স্মরণশক্তির স্বল্পতা, সূক্ষ্ম বা দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা মানুষ ভাগ্যক্রমে বা জন্মগতভাবে অর্জন করে না। বরং মস্তিষ্ক যত ব্যবহৃত হবে, তত এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

গবেষণায় দেখা যায়, জীবনে মানুষ তার মস্তিষ্কের সামর্থ্যের খুব সামান্যই ব্যবহার করে থাকে। সে হিসেবে মস্তিষ্কের বড় একটি অংশই অব্যবহৃত থেকে যায়। ধারণা করা হয়, মাংসপেশির মতোই মস্তিষ্কেরও যত বেশি চর্চা ও ব্যবহার করা হবে, ততই এটি কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। তীক্ষ্ণ বা ক্ষুর ধারও হবে। মস্তিষ্ক ধারালো ছুরির মতো, যতো ব্যাবহার করা যাবে ততোই ধারালো ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে। যতই নতুন নতুন কাজে লাগাবেন ততোই ক্ষমতা বাড়তে থাকবে। এক সময় অভিজ্ঞাতা লাভ করতে করতে অনেকটাই দ্রুত কাজ করতে শুরু করবে।

মস্তিষ্ককে উপযুক্ত ট্রেইন করলে বৃদ্ধ বয়সে মস্তিষ্কের নানান রোগ যেমন ডিমেনশিয়া, আলঝাইমার থেকে অনেকাংশে মুক্তি লাভ করা যায়। স্মৃতিশক্তি হ্রাসের প্রবণতা বর্তমানে সব বয়সীদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া, দ্রুত কোন কিছু শেখা, সব কিছুই আরও কার্যকারীভাবে করার জন্য মস্তিষ্কের সুষ্ঠু ব্যবহার প্রয়োজন। মানুষের মস্তিষ্ক মোটামুটি আনলিমিটেডই বলা চলে। কম্পিউটারের র‌্যামের মত এর কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।

পার্সোনাল কমপিউটারের মতো মস্তিষ্কের কোনো কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র বা সিপিইউ নেই। পঞ্চে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মস্তিষ্ক বাইরে থেকে সংকেত গ্রহণ করে। তারপর এর বহুধাবিস্তৃত নেটওয়ার্কের সাহায্যে দৃষ্টি, শ্রুতি, বাচন, স্নায়ুকোষ নিয়ন্ত্রণসহ অন্য বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার পরিচালনা সম্পন্ন করে। কিন্তু এসব কাজ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত থাকে না। বরঞ্চ দেখা যায়, একাধিক অঞ্চলের সমন্বিত প্রক্রিয়ায় কোনো একটি কাজ সমাধা হচ্ছে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এখনো পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাই ত্রিভূবনের সবচেয়ে জটিল ও রহস্যময় বস্তুু হলো মানুষের মস্তিষ্ক। গড়পরতায় মানুষের মগজের ওজন দেড় কিলোগ্রাম যার মধ্যে প্রায় এক বিলিয়ন সংখ্যক নিউরণ বা স্নায়ুকোষ আছে। মানুষের মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহ করে রাখার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তিই মানুষের বড় সম্বল। এই শক্তি ছাড়া মানুষ জড় পদার্থের সমান। তাই মস্তিষ্ক সঠিক ভাবে সাথে সবকিছু পরিচালিত করতে পারে এবং সুষ্ঠু ভাবে কাজ করতে পারেন এ ব্যাপারে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পাশাপাশি আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়তই যুগের সাথে সাথে উন্নত এবং বেশি কার্যক্ষমতা সম্পন্ন গড়ে তুলতে হবে। মস্তিষ্ককে শক্তিশালী, সুস্থ রাখার বিষয় নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির উপায় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। তেমন একটি পরীক্ষামূলক কাজ হলো মানব মস্তিষ্কে মেমোরি কার্ড বসানো! মোবাইলসহ বিভিন্ন ডিভাইসে মেমেরি কার্ড ব্যবহার করা হয়। তাতে সংরক্ষণ করা হয় নানা প্রয়োজনীয় তথ্য।

ইউএসএ টুডে সূত্রে জানা যায়, এবার মানব মস্তিষ্কেও বসানো হবে মেমোরি কার্ড, যেন পুরনো কোনও কথা আর কেউ ভুলে না যায়। পাশাপাশি এতে থাকবে আরও অনেক সুবিধা। এমন উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান নিউরোটেক স্টার্টআপ নিউরালিংক। ইতোমধ্যেই এই ব্রেইন চিপ বানরের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এখন মানুষের মস্তিষ্কে পরীক্ষা চালানোর প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। সম্প্রতি নিউরালিংক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডিরেক্টরের জন্য একটি চাকরি সংক্রান্ত পোস্ট দিয়েছে। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যারা এই কাজের জন্য আবেদন করতে ইচ্ছুক তাদের অবশ্যই এই কাজ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। পাশাপাশি এই কাজের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী এবং ভালোবাসা থাকাটাও দরকার। নির্বাচিত ব্যক্তিরা নিউরালিংকের প্রথম ক্লিনিকাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী হিসেবে কাজ করারও সুযোগ পাবেন।

জানা গেছে, নিউরালিংক ইতোমধ্যেই একটি বানরের ওপর ব্রেইন চিপটি ব্যবহার করে পরীক্ষা চালিয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্রেইন চিপটি স্থাপনের পর বানরটি মন দিয়ে ভিডিও গেমস খেলতে পারছে।

কিন্তু কেন এই ভাবনা? ইলন মাস্কের মতে, প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বা যারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলার মতো ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন, মূলত তাদের কথা চিন্তা করেই এই ভাবনা।

ইলন মাস্ক বলেছেন, নিউরালিংক ডিভাইসটি একটি ছোট্ট কয়েনের আকারের এবং এটি খুব সহজেই মাথার ভেতরে স্থাপন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে প্রথমে মস্তিষ্কের ব্যাধি এবং রোগে আক্রান্তদের নিরাময় দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এটি সফল হলে- শুধু মাত্র এই একটি যন্ত্রের সাহায্যেই মস্তিষ্ক ও মেরুদ-ের সমস্যা সহজেই সমাধান করা যাবে। এর মাধ্যমে পক্ষাঘাত, শ্রবণশক্তি ও অন্ধত্বের সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। শুধুই তা-ই নয়, এই ডিভাইসের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যাবে মানুষের স্মৃতি। এটি দিয়ে মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি কম্পিউটারকে সংযোগ করা যাবে।

বাজারে ১ জিবি, ২ জিবি এভাবে ১২৮ জিবি বা আরও বেশি জিবির মেমোরি কার্ড বা পেনড্রাইভ পাওয়া যায়। কিছু কিছু হার্ডডিস্ক ও পেনড্রাইভ ১০০০ থেকে ২০০০ গিগাবাইট পর্যন্ত মেমোরি ধারণ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আজও মানুষের ব্রেনের ক্যাপাসিটি বা ধারণক্ষমতা নির্ণয় করতে সক্ষম হননি। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনি যদি ৩০ লাখ ঘণ্টা বা ৩৪২ বছর একনাগাড়ে মস্তিষ্কের মেমোরি কার্ডে সারাক্ষণ ভিডিও ধারণ করেন, তাতেও আপনার মস্তিষ্ক নামের সুপার কম্পিউটারের মেমোরি স্পেস পূরণ হবে না।

মস্তিষ্কের মেমোরি স্পেস নিয়ে গবেষণা তথ্যে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির অধ্যাপক ড. পল রেবার উল্লেখ করেছেন, মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে ১০০ কোটি বা এক বিলিয়ন নিউরণ। প্রতিটি নিউরন একে অপরের সঙ্গে গড়ে তুলেছে ১ হাজার সংযোগ, যার গাণিতিক সংখ্যা হবে এক ট্রিলিয়নের বেশি।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি প্রতিটি নিউরণএকটি করে মেমোরি ধারণ করে তা হলেও কারও জীবদ্দশায় কখনও মেমোরি স্পেস শেষ হবে না। বরং এক একটা নিউরণ অসংখ্য মেমোরি ধারণ করতে সক্ষম। ব্রেন যদি কোনো সর্বাধুনিক ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডারের মতো মেমোরি ধারণ করে, তা হলে সেই মেমোরি যদি কোনো টিভিতে অবিরাম সম্প্রচার করা হয়, তা হলে তিন শতাধিক বছর লাগবে তা প্রচার করতে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রেনের মেমোরি ধারণক্ষমতা কমপক্ষে ২ দশমিক ৫ পেটাবাইট অথবা ১ মিলিয়ন জিবি বা ১০ লাখ গিগাবাইট ধারণক্ষমতা রয়েছে মস্তিষ্কের মেমোরি কার্ডের! এমনতর সম্পদের ভান্ডারে কৃত্রিম মেমোরি কার্ডের পথচলা কিভাবে হয় তাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক: ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button