মতামত

গ্রিন টেকনোলজিতে নতুন আশা দেখছে বিশ্ব

ফজলুর রহমান:: মানুষ এক সময় প্রকৃতির সাথে খেলছিল, আর আজ প্রকৃতিই যেন মানুষের সাথে খেলছে। খেলতে খেলতে এখন প্রকৃতি সর্বনাশা রূপ নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে হাজির। এখন তাই নতুন করে ভাবতে বসেছে বিশ্ব। আশার আলোও পাওয়া যাচ্ছে এআ প্রকৃতিতেই। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, সবুজ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই প্রকৃতির বিপুল শক্তি থেকেই গড়ে তোলা যাবে নিরাপদ প্রতিবেশ।

নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রচলিত প্রযুক্তির বিবর্তন প্রযুক্তি জগতে এক নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি ও ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে আমরা গ্রিন টেকনোলজি বলতে পারি। অন্য কথায়, ‘সবুজ প্রযুক্তি ‘বলতে এমন প্রযুক্তিতে বোঝায় যা পরিবেশবান্ধব প্রকৃতির এবং এই প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য বিঘœ করে না, বরং প্রাকৃতিক সম্পদকে সংরক্ষণ করে। সবুজ প্রযুক্তি ‘ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি’ এবং  ‘পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি’, ‘জলবায়ুবান্ধব প্রযুক্তি বা ক্লাইমেট-টেক’ নামেও পরিচিত। ক্রমবর্ধমান মানুষ, ক্রমধ্বংসমান পরিবেশ এবং ক্রমহ্রাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ- এর বিপরীতে এই গ্রিন টেকনোলজিকেই আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্থিতিশীল ও বিকল্প পরিবেশ ভাবনার লক্ষ্যে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এজন্য যেসব উপকরণ পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায়, সেসব শনাক্ত করতে হবে এবং এসব উপকরণের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সকলের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশেষভাবে প্রয়োজন। গ্রিন টেকনোলজির প্রধান লক্ষ্য হলো পৃথিবীতে প্রাকৃতিক উৎস ধ্বংস না করে প্রযুক্তি উৎপাদন করার উপায় খুঁজে বের বরা। আর এই টেকনোলজির সুবিধা হলো- এটি পুনরায় ব্যবহার করা যাবে।

গ্রিন টেকনোলজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। সবুজ প্রযুক্তির মাধ্যমেই বায়ু শক্তি, জৈব জ্বালানি, বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি, ভূতাপ শক্তি, সামুদ্রিক জোয়ার ভাটা শক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তির সীমাবদ্ধ, পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব হ্রাস করা এবং পুন:নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বেশিরভাগ কারখানার যন্ত্র উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে বর্তমানে অনেক বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী হয়েছে।

এরইমধ্যে পরিবেশবান্ধব গ্রিন টেকনোলজির উৎপাদন কেন্দ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে তোলা হয়েছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন এবং বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। আইসল্যান্ড, ইটালি, নিউজিল্যান্ডে ভূতাপ শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়েছে। চীন, মিশর, আরব আমিরাত, স্পেন, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতে ভালো মানের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। মেক্সিকো, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউক্রেইন, ইংল্যান্ডে বড়বড় বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। পেট্রোল, ডিজেল থেকে যানবাহনের পরিবেশ দূষণ রোধ এবং জ্বালানি খরচ সাশ্রয় করবার জন্য বিকল্প হিসেবে ব্যাটারি চালিত  ই-স্কুটার, ই-বাইক, ই-সাইকেলের ব্যবহার বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অধিক পরিমাণে দেখা যাচ্ছে। কৃষি শস্যের অবশিষ্টাংশ এবং কৃষি বর্জ্যকে গ্রিন টেকনোলজির বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন combustion, gasification, cogeneration Gi gva এর মাধ্যমে রূপান্তরিত করে বিদ্যুৎ ও তাপ শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে।

সারাবিশ্বে পরিবেশের বিপর্যয় রোধে গ্রিন টেকনোলজি ব্যবহারের ওপর সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে এবং এই প্রযুক্তি প্রসারে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। ক্লাইমেট সেভারস নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টেল, গুগোল, মাইক্রোসফট, এইচপি’র মতো নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় তৈরি হয়েছে ৷ তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি তৈরিতে পরষ্পরকে সহায়তা করা৷

বিষয়টি নিয়ে ক্লাইমেট সেভারস এর কমিউনিকেশন ম্যানেজার বারবারা গ্রিমস বলেন, “ক্লাইমেট সেভারস হচ্ছে একটি উদ্যোগ যেটাতে পরিবেশকে বাচাঁতে নামকরা তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ইত্যাদিকে একত্রিত করা হয়েছে৷ আমরা প্রযুক্তি পন্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করছি৷

সম্প্রতি টেলিনর বলছে- ‘দ্রুতই গ্রিন ক্লাউডের ব্যাপক প্রসার ঘটবে, জলবায়ু বিষয়ে মাইক্রো ডিগ্রির চাহিদা বাড়বে, সবকিছুর অপটিমাইজেশন বা সর্বোত্তম ব্যবহার গুরুত্ব পাবে, সবুজায়ন বিষয়ে আন্দোলন বা গ্রিন-ইনফ্লুয়েন্সার কর্মকান্ড বাড়বে এবং ‘লস্ট জেনারেশন’ বা পরবর্তী প্রজন্মের উপযোগী অফিস ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। আর কোম্পানিগুলো এই খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ করবে।’

টেলিনরের পূর্বাভাস তুলে ধরে টেলিনর রিসার্চের প্রধান বিওন তালে স্যান্ডবার্গ সম্প্রতি বলেন- “নতুন যুগের উন্নত কানেক্টিভিটি, জলবায়ুবান্ধব শক্তি সাশ্রয়ী আধুনিক হার্ডওয়্যার, এজ ক্লাউড ও ফাইভ-জি প্রযুক্তি আরো পরিবেশ-বান্ধব হবে। তা প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রিন জব স্কিলসের চাহিদা এবং ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্লাইমেট মাইক্রো ডিগ্রি দেয়ার বিষয়গুলোকে বাড়িয়ে তুলবে।”

ধারণা করা হচ্ছে, গ্রিন টেকনোলজির প্রসারের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শক্তি-সাশ্রয়ী ও পরিবেশ-বান্ধব ডিভাইস তৈরির প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা বাড়বে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসি সারা বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন, তার প্রভাব ও ঝুঁকি-সংক্রান্ত তথ্যাবলি সরবরাহ করে। এই সংস্থার পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের গড় উষ্ণতা প্রাক-শিল্পায়নের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ উষ্ণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ উত্তরোত্তর উষ্ণতা বৃদ্ধি ভৌগোলিক চরিত্র ও জনজীবন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই সবুজ প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত জরুরি। সবুজ প্রযুক্তির আরো অধিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করে কাজ করলে সম্ভাব্য ঝুঁকিসমূহের দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা সম্ভব। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ভাবনায় সচেতনভাবে সবুজ প্রযুক্তির ধারণাকে প্রয়োগ করে পৃথিবীকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে হবে।

লেখক: ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button