শিল্প ও সাহিত্য
বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম:: দশম হিজরিতে বিশ্বনবী সৈয়্যদুল মুরসালিন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘোষণা করলেন, তিনি হজ্বে যাবেন, তখন সারা আরবে এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে গেল। হাজার হাজার ভক্ত-অনুরক্ত সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম নবীজির সফরসঙ্গী হওয়ার লক্ষে একত্রিত হতে লাগলেন। শুক্রবার ভোরেই হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে পৌঁছে যান। সেখানে নামিরার তাঁবুতে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। দ্বি প্রহরে কাসওয়া নামক উটনীতে আরোহণ করে কাছাকাছি বতনে আরনায় যান। সে সময় সরকারে মদীনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার চার পাশে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম সমবেত ছিলেন। সরওয়ারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত জন সমুদ্রের উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করলেন। ঐতিহাসিকরা সে খুতবাকে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হাদিস গ্রন্থগুলোয় বর্ণিত বহুসংখ্যক হাদিস থেকে সে খুতবার সার সংক্ষেপ পাঠক সমীপে তুলে ধরা প্রয়াস পেলাম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার।
আমি তাঁর প্রশংসা করছি, তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করছি।…..হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করার জন্য আমি তোমাদের উপদেশ করছি। তাঁর আনুগত্যের জন্য প্রণোদিত করছি। শুভ কামনা করে আমার বক্তব্য শুরু করলাম। উপস্থিত জনমন্ডলী! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির প্রতি দয়া করুন, যে আমার বক্তব্য শুনে স্মরণ রেখেছে এবং এমন ব্যক্তির নিকট পৌছিয়েছে যে তা প্রত্যক্ষভাবে শুনে নি। হয়তো আমি আর কখনো এখানে তোমাদের সঙ্গে একত্রিত হতে পারবো না। হে জনমন্ডলী! আজকের এই দিন (জুমার দিন), এই মাস (জিলহজ মাস) ও এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র; তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু, মান-সম্মান কিয়ামত পর্যন্ত তেমনই পবিত্র। সাবধান! আজ থেকে জাহেলিয়াতের সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো।
সর্বপ্রথম আমি আমাদের প্রাপ্য হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ রহিত করছি। মূলধনে তোমাদের অধিকার অব্যাহত থাকবে। তোমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করবে না, নিজেরাও অত্যাচারিত হবে না। পবিত্র কাবা ঘরের তত্ত¡াবধান ও হাজিদের জন্য পানি সরবরাহ ব্যতিত অন্ধকার যুগের সব নির্দশন বিলুপ্ত করা হলো।
হে মানবজাতি! তোমাদের নিজ স্ত্রীদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তদ্রæপ তাদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের তাদের প্রতি কঠোরতা করার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং (প্রয়োজনে) মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়ম মাফিক তাদের ভরণপোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তারা তোমাদের সাহায্যকারিণী। তোমরা তাদের আল্লাহর নির্ধারিত কালিমা বাক্যের (ইজাব-কবুল) মাধ্যমে নিজেদের জন্য হালাল করেছো। সুতরাং তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। হে জনমন্ডলী! তোমাদের প্রভু একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। সাবধান! অনারবের উপর আরবের কিংবা আরবের উপর অনারবের, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মাঝে যারা সর্বাধিক মুত্তাকি, খোদাভীরু তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান। সাবধান! অপরাধীই নিজ অপরাধের জন্য দায়ী। পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী হবে না এবং পুত্রের অপরাধে কোনো পিতা দায়ী হবে না। জেনে রাখো! নিশচয় মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। মুসলমানগণ এক অভিন্ন ভ্রাতৃসমাজ।
কারো জন্য অন্যের সম্পদ বৈধ নয়। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয় তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। সাবধান! তোমাদের এই শহরে শয়তানকে কেউ পূজা করবে- শয়তান এ আশা চিরতরে ত্যাগ করেছে; কিন্তু যেসব কাজকে তোমরা অতি হালকা বলে মনে করো, এরূপ কাজে তোমরা শয়তানের আনুগত্য করবে এবং এতে সে খুশি হবে। সুতরাং তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সতর্ক থাকিও। হে জনগণ!
তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করো; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো; রমযান মাসের রোযা রাখো; সম্পদের যাকাত আদায় করো; তোমদের শাসকদের আনুগত্য করো (যতক্ষণ না শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়), তবেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। আমার পরে তোমরা পরস্পর খুনাখুনি করে (প্রাণঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হয়ে) কুফরিতে ফিরে যেয়ো না। আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে কখনো বিভ্রান্ত হবে না। তা হচ্ছে- আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কোরআন) ও তাঁর রাসুলের সুন্নাত, আরেক বর্ণনায় আমার পরিবারবর্গ।
হে মানবমন্ডলী! আমার পরে আর কোনো নবী নেই এবং তোমাদের পরে আর কোনো উম্মত নেই। আমার ব্যাপারে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন তোমরা আমার ব্যাপারে কী বলবে? উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়ল্লাহু আনহুম উত্তর দিলেন, আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি আপনার দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন। আপনি (উম্মতকে) নসিহত করেছেন) এবং আপনি দায়িত্ব (যথাযথ আমানত) পালন করেছেন।
অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তর্জনী আকাশের দিকে তুলে এবং সমবেত উপস্থিত জনতার দিকে নামিয়ে ইঙ্গিত করে (তিনবার) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। তারপর বললেন, তোমরা এখানে যারা উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে (কথাগুলো) পৌঁছে দেবে। আর অবতীর্ণ হয় সূরা আল-মায়িদার ৩নং আয়াত সর্বশেষ ঐশীবাণী- ‘যারা কুফরী করেছে, আজ তারা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না,বরং আমাকে ভয় কর।
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।’ (সহীহ বুখারী,খন্ড-২,পৃ:৩২,৬১৯; সহিহ মুসলিম,খন্ড-১,পৃ:৩৯৪,৩৯৭; জামে তিরমিযি, হাদীস:৩৭৮৮,৫০৫৭;মুসনাদে দারেমী, খন্ড-২,পৃ:৩২০; সুনানে ইবনে মাজাহ,পৃ:১২৯; মুসনাদে আহমদ,খন্ড-৫,পৃ:২৫১; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া,খন্ড-৫,পৃ:২০৩)
একটি কল্যাণমুখী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত খুতবার আবেদন সর্বজনীন। ইংল্যান্ড ঘোষিত ম্যাগনা কার্টা এর পনের শত বৎসর পূর্বে আরাফাতে রাসুলুল্লাহ প্রদত্ত ঐতিহাসিক খুতবা বিশ্বজনীন মানবাধিকারের দলীল হিসাবে স্বীকৃত। বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা ইসলামের বিধানাবলিই উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনেরই যেন সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন। গোটা মানবতার জন্য কল্যাণকর পূর্ণাঙ্গ, উচ্চাঙ্গীন এমন কোনো ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেওয়া হয়নি। তাকওয়া, খোদাভীতি, মানবাধিকার বিশেষত নারীর অধিকার, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী, পরকাল-ভাবনা, দীন প্রচারে সক্রিয় হওয়া, আমানতদারি, বর্বর যুগের মূর্খতা বর্জন, সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বিলুপ্তি কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এই ভাষণে। এ জন্য বিদায় হজের ভাষণ প্রকৃত অর্থেই একটি কালোত্তীর্ণ ভাষণ। কিয়ামত অবধি মানুষের জন্য চির অনুসরণীয়। প্রতিটি স্তরের মানুষের উচিত এ ভাষণ বারংবার পড়া, পর্যালোচনা করা এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। বাস্তব জীবনে তা পালন করা। তবেই কাক্ষিত সফলতা অর্জন হবে।
লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ,রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম।