নতুন শিক্ষাক্রম প্রসঙ্গেঃ প্লিজ, বইটি একবার খুলে দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থীরা সারাবছর রান্না শিখবে??
বিবি হাওয়া স্নেহা::
নতুন শিক্ষাক্রম, শিক্ষার্থীরা সারাবছর রান্না শিখবে??
সম্প্রতি এক ভদ্রমহিলা অভিযোগ করেছেন- “জীবন ও জীবিকা নতুন চার্মিং বিষয়। ক্লাস সিক্সের বাচ্চাকে কেন স্কুলে সারাবছর রান্নাবান্না শেখাবে? এটা তো পারিবারিক শিক্ষা!”
উনি একজন অভিভাবক হিসেবে উনার দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় একথা বলতেই পারেন। কিন্তু, যখন শিক্ষক সমাজ এর পক্ষে তালি বাজান, টিপ্পনী কাটেন-একেবারে ধুয়ে দিয়েছে! তখন সত্যিই খুব দু:খ লাগে!
শিক্ষক এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের অন্তত জানা উচিত – উনার বক্তব্য কতোটা সঠিক! যেহেতু আমরা সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়েই কাজ করি।
আমাদের জানা উচিত– এটি নতুন বিষয় নয়, পূর্বের শিক্ষাক্রমে ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ নামে এটি ছিলো স্বল্প পরিসরে। আর আমাদের জাগতিক প্রায় সকল কর্মকান্ডের মূল উদ্দেশ্য জীবন ও জীবিকা। তাই এটি চার্মিং কোন বিষয় নয়।
চলুন জেনে নিই, ৭ম শ্রেণির তথাকথিত রান্নার বই থেকে সারাবছর কি কি যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করেছে শিক্ষার্থীরা।
প্রথমেই বলে রাখি, ১০টি বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় জীবন ও জীবিকা। এই বইয়ের ৯টি অধ্যায়ের মধ্যে একটিতে শিক্ষার্থীরা কুকিং স্কিল অর্জন করবে। বাকি অধ্যায়গুলোতে তারা শিখবে –
~নিজের কাজ নিজে করা,
~বাড়ির সদস্যদের কাজে সহায়তা করা,
~পরিবারের আয় ও ব্যায়ের সামঞ্জস্যতা বিবেচনা করা, ~পারিবারিক বাজেট করা, সঞ্চয় করা,
~পরিবর্তিত পেশা সম্পর্কে জানা, সকল শ্রেণি- পেশার মানুষকে শ্রদ্ধা করা,
~আগামীর প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা,
~আর্থিক লেনদেনে সততা ও সতর্কতা,
~নিজের আগ্রহ ও যোগ্যতা বুঝতে পারা এবং সেই অনুযায়ী লক্ষ্য নির্ধারণ করা ও বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা করা , ~পরিকল্পনার কৌশল জানা, লক্ষ্য নির্ধারণে পরিবার ও সমাজকে বিবেচনা করা,
~দলগতভাবে ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান করতে পারা,
~সঠিক উপায়ে পরিবারের অসুস্থ,বয়স্ক, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সদস্যদের সেবা প্রদান করতে পারা,
~পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থানের নিমিত্তে মুরগি পালন ইত্যাদি সহ আরো অনেক কিছু।
এবার বলি, যে অধ্যায়ের দুশ্চিন্তায় অভিভাবকদের ঘুম হারাম, সে অধ্যায় শেষে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে-
~রান্নার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সাবধানতা/ সতর্কতা।
~ডাল, আলু, সবজি, মাছ ইত্যাদির পুষ্টিগুণ জানা ও শারীরিক সুস্থতায় এগুলোর প্রয়োজনীয়তা (যা আগে বিজ্ঞান বইয়ে ছিলো। একদিকে মুখস্ত করতাম,অন্যদিকে ভুলে যেতাম)!
~রান্নার সাথে পারিবারিক বন্ধন জড়িত (মায়ের হাতের রান্না একসাথে বসে খাওয়ার মিষ্টি স্মৃতি নিশ্চয়ই ভুলিনি আমরা)
~রান্নায় সৃজনশীলতা ও বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশন।
~রঙ ও গুণাগুণ বজায় রেখে রান্না।
~বাড়িতে যারা রান্না করে তাদের কষ্ট অনুভব করা ইত্যাদি।
দয়া করে বলুন– সারাবছর ডাল-আলুভর্তা রান্না শেখানোর সুযোগ আছে?
কিছু সম্মানিত শিক্ষক হয়তো আগ্রহী হয়ে বছর শেষে উক্ত কার্যক্রমের ছবি পোস্ট করছেন বা অনেকেই মূল বিষয়টি এখনো ধরতে পারেননি। কিন্তু, এটা হলে তো আমাদের শিক্ষকদেরই ব্যর্থতা, কারিকুলামের নয়।
ভদ্রমহিলা আরো বললেন– ‘রান্না এমনিই শিখে!’
আসলে, রান্না এমনিই শিখতে বাধ্য হয় মেয়েরা, প্রচলিত সমাজের নিয়ম রক্ষা করার জন্য! তা না হলে, সকলে শিখলে আদরের ছেলে-মেয়ে মেসে গেলে কিংবা ঘরের বাইরে থাকলে অপরিষ্কার হাতের কিংবা অনিরাপদ রান্না না খেয়ে নিজেই রান্না করতে পারতো।
নিজের পরিবারের জন্য রান্না করলেই যদি বুয়া/বাবুর্চি হয়ে যায়, তাহলে তো আমার মা- দাদী-নানী সবাই বুয়া/বাবুর্চি!
বর্তমানে যেসব নারী বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত- তারা সবাই গার্হস্থ্য বই পড়েই এসেছেন।গার্হস্থ্য বইয়ে রান্নার অধ্যায় আগেও ছিলো। তো তারা তো বুয়া হয়ে যাননি!
এখন একই টপিক ছেলে-মেয়ে উভয়েই পড়বে। তাই এটা নিয়ে এই অহেতুক কচকচানি। অথচ রেস্টুরেন্টে গিয়ে আয়েশ করে পুরুষ শেফের রান্না চেটেপুটে খাই! এমনও আছে, কোন কোন শেফের একমাসের বেতনে কোন কোন চাকুরীজীবির গোটা বছরই হয়তো চলে যাবে!
তাহলে, আমরা কাকে ছোট করছি, কেন করছি?
নাকি আমরা চাইনা দরিদ্র পরিবারের কেউ এতকিছু বিনামূল্যে শিখুক?
এতগুলো মানুষ, কান চেক না করে চিলের পিছে ছুটছেন-এটা আমার বিশ্বাস হতে চায়না! প্লিজ, নিজেরা আগে একটু বইটা খুলে দেখুন। অনলাইনেই পাবেন।
(চলবে…)
বিবি হাওয়া স্নেহাঃ শিক্ষক, লেখক ও সংগঠক।