নতুন শিক্ষাক্রম আসলে কতটুকু ডিভাইস নির্ভর?
বিবি হাওয়া স্নেহা:: শেষ হলো নতুন শিক্ষাক্রমের প্রথম বার্ষিক চূড়ান্ত মূল্যায়ন। আমাদের অভিভাবকরা সব থেকে বেশি যে অভিযোগটি করেছেন তা হলো- আমাদের সন্তানেরা দিনরাত ডিভাইস বা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। এই অভিযোগ সত্য হলেও কতটুকুইবা কারিকুলামের দোষ বা মূল্যায়ন নির্দেশনায় আসলেই কী ছিল? চলুন একটু সংক্ষেপ দেখে আসি…
৬ষ্ঠ শ্রেণির আলোকে…
বাংলা: সাহিত্য মেলার আয়োজন করে নিজেরাই সাহিত্যকর্ম (ছড়া,কবিতা,প্রবন্ধ,গল্প,নাটক,গান)রচনা করে প্রদর্শন ও উপস্থাপন করেছে। পাশাপাশি একে অপরকে মূল্যায়ন করেছে।
গণিত: প্রকৃত-অপ্রকৃত ভগ্নাংশ চিহ্নিত করা, ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করা, দশমিক ভগ্নাংশে প্রকাশ ও সংখ্যা রেখায় স্থাপন, বর্ণনাভিত্তিক হিসেবকে বীজগাণিতিক রাশিতে প্রকাশ ও সমাধান, নিজের আনা নমুনা বক্স থেকে ঘন বস্তুর তলের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও ক্ষেত্রফল নির্ণয় করেছে।
ইংরেজি: ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ অনুযায়ী শুভেচ্ছা,সম্ভাষণ বা মন্তব্য করা, বিভিন্ন ভাষাগত বিষয় শেখা (parts of speech, article, tense, punctuation mark) ইত্যাদি মনোযোগ সহকারে শুনে যৌক্তিক মতামত প্রদান, নিজের অভিজ্ঞতা ও কল্পনাকে সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
বিজ্ঞান: স্কুলে বা বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তির ধরন ও কাজ অনুসন্ধান করে শক্তি স্থানান্তর পর্যবেক্ষণ, জ্বালানীর হিসেব, অপচয় হচ্ছে কিনা, পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্লেষণ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এটি ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি করেছে।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান: এলাকার ভৌগোলিক ও সামাজিক উপাদান এবং মানুষের উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ভৌগলিক উপাদানের পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রাণী সংরক্ষণে মানুষের করণীয় সমূহ চিহ্নিত ও উপস্থাপন করেছে।
ইসলাম ধর্ম: কোরআন হাদিস ও পাঠ্য পুস্তকের আলোকে কিভাবে নিজ প্রেক্ষাপট বা পরিবেশে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয় তা অনুসন্ধান, দায়িত্বশীল আচরণ নিয়ে ভূমিকাভিনয় করেছে (যেমন-পরোপকার, অভাবগ্রস্তকে সহযোগিতা, সেবা ইত্যাদি)।
ডিজিটাল প্রযুক্তি : নিজের এলাকায় প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কারণে জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে করণীয় কি? কীভাবে কানেক্টেড থাকা যায়? এ ধরনের পরিস্থিতিতে কি কি সাইবার অপরাধ হতে পারে? ইত্যাদি চিহ্নিত করে সেমিনার করেছে ও প্রতিবেদন লিখেছে।
জীবন ও জীবিকা: দলগতভাবে বিদ্যালয় বা সামাজিক কোন সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধানের উপায় চিহ্নিত করে স্বল্প বাজেটে দায়িত্ব ভাগ করে সমাধান করেছে, নিজের পছন্দ ও যোগ্যতা বিবেচনা করে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা করেছে ও উক্ত পেশায় প্রযুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করে তার সাথে অভিযোজন এর মানসিক প্রস্তুতির চেষ্টা করছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা: দলভিত্তিক খেলায় অংশগ্রহণ মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি, সহযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি, নিজের ধারণা ইতিবাচকভাবে প্রকাশ, অন্যের অনুভূতিকে সম্মান করা ও সম্পর্কের যত্ন করা শিখেছে।
এবার বলুন- এখানে কোন নির্দেশনাটি মোবাইল দেখে করতে হবে? কোনটি গুগল থেকে হুবহু কপি করার মত? কিন্তু তারা করেছে। কেন করেছে?
এর কয়েকটি কারণ আছে।
প্রথমত, আমরা শিক্ষকরা বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারিনি এবং মূল্যায়নের সময় তদারকি করার সুযোগ হয়নি বা ইচ্ছে করে করিনি।
দ্বিতীয়ত, আগেই নির্দেশনাগুলো প্রকাশ হওয়াতে আমাদের সন্তানদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফিডার প্রস্তুত করে রেখেছিলো, যাতে শিক্ষার্থীরা আগের মত ফিডার গিলে হলে গিয়ে বমি করে আসতে পারে।
আরেকটি কারণ হলো- শিক্ষক,শিক্ষার্থী,অভিভাবক এবং তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী- সকল পক্ষেরই নৈতিক মূল্যবোধ ও আন্তরিকতার অভাব!
আর ডিভাইস বা মোবাইল নির্ভরতা কিন্তু গত এক বছরে হয়নি। ছোটবেলায় খাবার খাওয়ানোর জন্য মোবাইলটা আপনিই তার হাতে প্রথম তুলে দিয়েছিলেন! আপনিই হয়তো কাজ করা বা টিভি দেখার জন্য ওর হাতে মোবাইল দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন!
আগামী বিশ্ব প্রযুক্তির। আপনার মা-বাবা যে প্রযুক্তি কল্পনাও করেননি, আপনি সে প্রযুক্তি নিয়মিত ব্যবহার করছেন। তাহলে আপনার সন্তান অবশ্যই আপনার থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকবে-এটা স্বাভাবিক। শুধু খেয়াল রাখবেন- সে যেন প্রযুক্তির সঠিক এবং ইতিবাচক ব্যবহার করতে পারে।
(চলবে...)
লেখকঃ বিবি হাওয়া স্নেহা, শিক্ষক, লেখক ও সংগঠক।