রাউজানে পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষের
অতিথি পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত রাউজানের কোয়েপাড়া গ্রামের গোলাম কিবরিয়া পুকুর ও বিভিন্ন দিঘি
আমির হামজা, রাউজান:: অতিথি পাখি ও প্রকৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন এখন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়েপাড়া গ্রামের গোলাম কিবরিয়া বাড়ির বিশাল পুকুর। শীতের শুরু থেকে এই পুকুরে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে অতিথি পাখির দল। ভোরবেলা হলে পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে এখানকার মানুষের।
এসব বিদেশী পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে শুধু এই গ্রামে নয়, উপজেলার কদলপুর লস্কর দিঘি, গহিরা নরসরত বাদশা দিঘি, রায় কুকুট দিঘি, নোয়াজিষপুর ঈসা খাঁ দিঘি, হালদা নদীসহ বড় আকৃতির জলাশয় গুলোতে এখন অতিথি পাখির মেলা বসেছে। আর এই পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙছে কয়েক গ্রামের মানুষের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়েপাড়া গ্রামের গোলাম কিবরিয়া বাড়ির জামে মসজিদের পুকুরে অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরন, জলকেলি ও কিচিরমিচির কলতানে মুখর পুকুটি। এই পুকুরের স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিরা। আবার কেউ কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়ে পুকুরে থাকা বাঁশের উপর ঘুমাছেন সেই দৃশ্য মুগ্ধ করছে। সন্ধ্যা হলে আশ্রয় নেয় আশেপাশের গ্রামের গাছগাছালিতে। সকাল হলে আবারও তাদের শুরু হয় ব্যস্ততা। এলাকার প্রকৃতিপ্রেমীরা প্রতিদিন বৈচিত্র্যময় এ দূশ্য দেখতে ভিড় করেন। বিশেষ করে কোয়েপাড়া গ্রামের পাশে কর্ণফুলী নদী ঘিরে খেলার ঘাটে বসে পর্যটকের মেলা। সেখানে বেড়াতে আসা লোকজন খবর পেয়ে অতিথি পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করে যাচ্ছেন।
কোয়েপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো: আবুল বশর বলেন, একসঙ্গে এত পাখি আমাদের মুগ্ধ করেন। অতিথি পাখি আমাদের গ্রামে এসে আমাদের গ্রামকে আলোকিত করেছেন। পাখিগুলোর জন্য আমি প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচ করে এই পুকুরে তাদের জন্য বাঁশবেঁধে দিয়েছি। যাতে তারা সেখানে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। তিনি জানান গত পাঁচবছর ধরে এই পুকুরে অতিথি পাখিরা দলবেঁধে বেড়াতে আসেন। এই অতিথি পাখিদের অতিথি হিসেবে আমাদের গ্রামের ছোটবড় সবাই স্বাগত জানান। যখন পাখিগুলো থাকে, তখন পুকুটি মুখর করে রাখে। আবার যখন থাকে না, তখন পুকুটি শূন্য শূন্য মনে হয়। পাখিগুলোকে সবসময় দেখে রাখি, যাতে কেউ তাদের বিরক্ত না করেন।
বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো: আবু জাফর রাশেদ জানান, আমাদের গ্রামে অতিথি পাখি এসেছে, দেখে খুবই ভালো লাগে। একসঙ্গে এত পাখি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আমি সময় পেলে পাখিগুলো দেখতে চলে আসি। অতিথি পাখিদের আসার মধ্যে বোঝা যাই, আমাদের রাউজান একটি শান্তির জনপদ। অতিথি পাখিদের নিরাপদ অভয়ারণ্যে সৃষ্টি করতে, রাউজানের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। আগত অতিথি পাখি গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের এলাকার সকল মানুষ আন্তুরিক ভাবে দেখভাল করেন। তাই রাউজানকে নিরাপদ মনে করেন আগত অতিথি পাখিরা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও হালদা গবেষক ড.মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, সারাবিশ্বে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৭শত প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৩’শত প্রজাতির পরিযায়ী পাখী। যার দুইশত দশ প্রজাতির পাখি শীতকালে বাকি পাখি অন্যসময় বিশেষকরে গ্রীস্মকালে আসে। শীতে বরফে যখন সব ঢেকে যাই এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয় তখনই এসব পাখি প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, পর্যাপ্ত খাদ্যে এবং নিরাপদ প্রজননের জন্য রাশিয়া, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চীন, ইউরোপ, ফিলিপাইন, এশিয়ার কিছু এলাকা, হিমালয় পর্বতমালার আশপাশ থেকে তুলনামূলক আমাদের দেশে কম ঠান্ড ও খাবার পাওয়া যায় তাই এসব এলাকায় আসে তারা।
তিনি জানান, পরিযারী পাখি প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার মাইল অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসে তখন আমাদের দেশের জলশায়গুলোতে পানি কমে যায় এবং প্রচুর খাদ্য পাওয়া যায়। মার্চের শেষের দিকে যখন গরম পড়ে এবং শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলা শুরু করে তখন আবার এরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যায়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা) বিশিষ্ট লেখক ফজলুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে শীত এলেই রং-বেরঙের নাম না জানা অনেক রকম পাখিরা এসে ভরে যায় আমাদের জলাশয়, হাওড়, বিল ও পুকুর। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। সেপ্টম্বর-অক্টোবরে দলবেঁধে আসতে শুরু করে এসব পাখি। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত তাদের কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে ভরিয়ে রাখে। দু:খের বিষয় এই যে, নিরাপত্তার জন্য এ দেশে অতিথি পাখিরা আসে কিন্তু শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রতিবছর এসব অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাখি শিকার বন্ধের পাশাপাশি পাখির যাতে নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারে, সেদিকে সবার দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। সবার উচিত অতিথি পাখিদের নিরাপত্তাদানে সজাগ থাকা।
তিনি জানান, পাখি প্রকৃতিতে ভারসাম্য আনে, নিসর্গকে সুন্দর করে, চোখের প্রশান্তি দেয়, সৌন্দর্য চেতনাকে আলোড়িত করে। পাখিরা আসুক দলে দলে, ওরা চারপাশ আলোড়িত করুক কলকাকলিতে। অতিথির ন্যায় আমাদের দেশে কিছুটা সময় তারা নির্বিঘে বেঁচে থাকুক এবং নির্দিষ্ট সময় শেষে মুক্ত ডানা মেলে নিজ দেশে ফিরে যাক। ওরা যেন আনন্দে আসে, যেন তৃপ্তিতে ফিরে যায় সে মানসিকতা গড়া দরকার।