শহিদী কাফেলার মেহমান, ফারুকী তোমায় হাজার সালাম
শেখ আল-আমিন রেযা: হটাৎ বাহির থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলাম! রাতে খাওয়া দাওয়া করে চোখে তখন ঘুম ঘুম ভাব। দু’একজনের চিৎকার না, শুনে বোঝা-ই যাচ্ছে বেশ ক’জন মানুষ তো হবেই। হটাৎ চিৎকার শুনে, মনটা কেমন জানি কেঁদে উঠলো। কিন্তু বাহিরে গিয়ে যে একটু দেখবো কারা চিৎকার করছে? সে সূযোগ টা নেই! বাহিরে যাবোই বা কি করে? তখন আমি মুর্শিদ কেবলার কালুরঘাট তৈয়্যবিয়া দরসে নেজামীর ছাত্র। সুতরাং সেখান থেকে বের হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
মনটা খারাপ হলো একটু। ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত পুহিয়ে সকাল হলো। মুয়াজ্জিন আজান দিলো। ফজরের নামাজ হলো। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম সকলে কি যেন বলাবলি করছে। মাদরাসার হুজুররাও আসছেন সেখানে। মাদরাসার স্টুডেন্ট হওয়ায় হুজুরদের পাশে গিয়ে শোনা হয়নি। মসজিদ থেকে বের হয়ে,সোজা লাইন ধরে মাদরাসায় চলে এলাম সবাই।
তখন সকাল ৭টা বাজে। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার কর্মীরাসহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত এর আক্বিদায় বিশ্বাসী সবাই, কালুরঘাট তৈয়্যবিয়া দরসে নেজামীর মাঠে এসে জড়ো হতে লাগলো। আজ কোনো মাহফিল বা প্রোগ্রামও নেই। আর কোনো প্রোগ্রাম থাকলেও কখনো এত সকাল সকাল কেউ মাদরাসায় এসে ভিড় জমায় না।
সুতরাং বুজতে আর দেরী হলোনা, কিছু তো একটা হয়েছে। মনটা সেদিন কারো পড়ায় বসছেনা। চোখ শুধু বাহিরেই পড়ে আছে। দেখতে পেলাম, মাদরাসা কমপ্লেক্স সংলগ্ন মাঠের পাশে কবরস্থান হতে ক’জন ভাই বাশ বাগান হতে বাশ কেটে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে। একটু অভাক হলাম। লাঠি কেন আবার? মনটা যেন আর মানছে না, কেন জানি অস্থিরতা বিরাজ করছে মনের মাঝে। কি হয়েছে যদি জানতে পারতাম।
এর মাঝেই খবর এলো, যেটি শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। হুজুর এলেন, হুজুর আমাদের দিকে লক্ষ করে মুখটা আধার করে, বলতে লাগলেন। আহলে সুন্নাত এর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, আহলে সুন্নাত নেতা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক শায়খ আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী (রহ.) কে গতকাল রাতে ২৭ শে আগস্ট (২০১৪ সাল) হত্যা করেছে জালিম ইয়াজিদ বাহিনী। হুজুরের হত্যার প্রতিবাদে আমরা সকল সুন্নি জনতা প্রতিবাদ সমাবেশ করবো।
যেই কথা সেই কাজ, পবিত্র কুরআন শরিফ তুলে রাখলাম। হালকা নাস্তা করে সকলে বের হলাম, মাদরাসা কমপ্লেক্স হতে শুরু হলো নারায়ে তাকবির, নারায়ে রেসালতের স্লোগান। স্লোগান হলো আল্লামা ফারুকী হত্যার বিচার চেয়ে। সারাদেশে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিলো সেদিন। চট্টগ্রাম এর কালুরঘাট হতে রাস্তার মাথা, সিএন্ডবি হয়ে বহদ্দারহাট বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হলো। অনুষ্ঠান শেষে ঘোষণা এলো, ৩১ই আগস্ট (২০১৪ সাল) সারাদেশে হরতাল। সেই ৩১ আগষ্ট, ছাত্রসেনার ইতিহাসগড়া একটি দিন।
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট প্রেসিডিয়াম সদস্য শহীদে মিল্লাত আল্লামা নূরুল ইসলাম ফারুকী (রহ) এর নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২০১৪ সালের ৩১ আগষ্ট ছাত্রসেনার ডাকে সারাদেশে পালিত হয়েছিল অর্ধবেলা হরতাল। জ্বালাও পোড়াও ছাড়া ছাত্রসেনা সেদিন শান্তিপূর্ণ ভাবে হরতাল পালন করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছিল।ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলো যেখানে হরতাল নিয়ে নেগেটিভ নিউজ লিখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ঠিক সে সময়ে কোন ধরনের সংঘাত – সহিংসতা না দেখিয়ে ছাত্রসেনার সর্বাত্মক হরতাল পালন দেশের সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
সেদিন দেশের প্রথম সারির সকল পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছিলো সারাদেশে এই প্রথম ভাঙচুর বিহীন হরতাল পালিত হয়েছে। এমনকি মিডিয়াগুলোও ছিল প্রশংসায় পঞ্চমূখ। এ যেন দাবি আদায়ের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা। সাধারণ মানুষের কাতারে থেকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নিয়ে কিভাবে হরতাল করতে হয়, তা সব রাজনৈতিক দলকে শিক্ষা দিয়েছে ছাত্রসেনা। আল্লামা ফারুকী সারা জীবন সালাতু সালামের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন।বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার কর্মীরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে সেদিন প্রিয়নেতা হত্যার প্রতিবাদে রওজা পাকে সালাতু সালামের নাজরানা পেশ করেছিল ।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ছিল। শিশু-কিশোর-তরুন,এমনকি বৃদ্ধরাও এসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিল।
❝সেদিন মিছিলে একজন বলছিলেন, আমার ঘরে আমার সাত বছরের এক ছেলে আছে। রমজান মাসে আল্লামা ফারুকী হুজুরের পরিচালনা ও উপস্থাপনার মুগ্ধতায় ঘেরা সেই কাফেলা অনুষ্ঠানের ভক্ত সে। আজকে হুজুর শহীদ হয়েছে শোনার পর থেকে সে সারাদিন না খেয়ে আছে। তাকে কোনো ভাবেই খাওয়াতে পারছি না। পৃথিবী কি নিষ্ঠুর। মাঝে মাঝে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা যেনো কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। মনকে কোনো ভাবেই বোঝানোর উপায় থাকে না। মানুষ নিরুপায় হয়ে যায়।❞
শুধু তাই নয়, টিভিতে ছাত্রসেনার সংগ্রামী ভূমিকা দেখে কাফেলা প্রেমী লাখো পর্দানশীন মা-বোনেরা সেদিন অশ্রুসিক্ত হয়েছিল।মাইলের পর মাইল হেটে অফিসগামী মানুষেরা সেদিন হরতাল নিয়ে বিরক্তি প্রকাশের পরিবর্তে হেটে যাওয়াকে মনে করেছিল সৌভাগ্যের কাজ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত এর একমাত্র ছাত্রসংগঠন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা যে অহিংস ছাত্ররাজনীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলে, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট যে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে তা হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার মাধ্যমে নিজেদের আদর্শকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিল আরেকবার। যারা রাজপথে থেকে ইতিহাসগড়া হরতাল করেছিল সে সব বীর সেনানী ও অগ্রপথিকদের আজকের এই দিনে হাজারো কুর্নিশ ও সশ্রদ্ধ সালাম।
কবিতার ছন্দে ছন্দে শেষ করতে চাই।
রাসুলের এই নিরলস কাফেলা চিরদিন বেঁচে থাকবে, শান্তির পথে মুক্তির পথে চিরদিন সব মানুষেরে ডাকবে। শহিদী কাফেলার মেহমান,ফারুকী তোমায় হাজার সালাম। রক্তাক্ত ২৭ আগষ্ট জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর সম্মান।
লেখক- মুহাম্মদ আল-আমিন রেযা
সভাপতি- চান্দগাঁও থানা,
সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক,
চট্টগ্রাম মহানগর উত্তর,
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা।