টেকসই বাঁধ চাই হালদা পাড়ের বাসিন্দারা
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ি: মাঠির,গাছ,বাঁশের কুঁড়ে ঘরগুলোতে ছিল সুখের বসবাস,দেখা হতো নানান স্বপ্ন। কেউ ছেলের জন্য বউ আনবে,কেউ মেয়ে বিয়ে দেবে,সামনের মৌসুমে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে এমন স্বপ্নও ছিলে অনেকের। হালদা পাড়ের মানুষের জীবন চিত্র ছিল এরকম।
কিন্তু হঠাৎ করে সব পরিণত হয় বিষাদে। কারো ঘর ভেসে নিয়ে যায়,কারো ঘর ভেঙ্গে পড়ে। সে সাথে ভাঙ্গে দেখা সব স্বপন।
সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয় ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতে। হালদার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে পরা পানিতে প্লাবিত হয় এ দুই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন। পানিবন্দী হয় হাজার হাজার পরিবার। বন্যা পরবর্তী ফুটে উঠে ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র।
বাড়িঘর,দোকানপাঠ,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট,চাষাবাদের ক্ষতি,মৎস্য চাষের ক্ষতিসহ সর্বত্রই ক্ষতির দাগ টেনে গেছে এ বন্যা।
ফটিকছড়ি উপজেলায় হালদার নদীর প্রায় ২২ টি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার সৃষ্টি হয়। উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভা, সুয়াবিল, সুন্দরপুর,হারুয়ালছড়ি,ভুজুপুর,নারায়নহাট ইউনিয়নের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী ছিল এ বন্যায়। শত শত পরিবার হয় ঘরহারা।
সরেজমিনে সুয়াবিল ইউনিয়নের পূর্ব সুয়াবিলে দেখা দিয়েছে বাড়িঘর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ভাঙনের চিত্র। এমন অসংখ্য বাড়িঘর ভেঙে গেছে এ এলাকায়।
উক্ত ইউপির ২নং ওয়ার্ডের পূর্ব সুয়াবিল এলাকার ইছহাক কামালের ঘর ভেঙে পড়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তিনদিন ঘরের ভেতরে পানি ছিল। বাড়িঘর ফেলে অন্যজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। কত কষ্ট সহ্য করেছি ঘরটা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু হালদার বাঁধ ভেঙে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু দুমড়ে মুচড়ে দিল।
একই এলাকার আরো কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন,গত ২০১৮ সালের বন্যায় একই জায়গায় বাঁধটি ভেঙেছিল। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ করার চেষ্টা করলেও স্থানীয় কিছু মানুষের বাঁধার কারণে তা আর হয়নি। এ জায়গা গুলোতে বাঁধ না হলে প্রতি বন্যায় এভাবে সবাইকে বাড়িঘর হারাতে হবে।
নাজিরহাট পৌরসভার নাছির মোহাম্মদ ঘাটের হালদার চরের কৃষক সোহেল বলেন- প্রবাস ছেড়ে এলাকায় কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। এবারের বন্যায় ৪০শতক জায়গার আখ চাষ আমার নষ্ট হয়েছে। এ ধাক্কা কিভাবে কাটিয়ে উঠবে জানিনা।
নাজিরহাট পৌরসভার হালদা পাড়ের বাসিন্দা সেলিম,রাজন,জাহাঙ্গীর বলেন,হালদা পাড়ের পানি উপচে পড়ে আমাদের এলাকার শত শত ঘর পানি পানিবন্দী ছিল।অনেক ঘর ভেঙ্গে পড়ে। আমরা টেকসই বাঁধ নির্মানের দাবী করছি।
হাটহাজারী -ফটিকছড়ি সীমান্ত নাজিরহাট নতুন ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম হালদার পাড়ের প্রায় ২০/২৫ ফুট ভেঙে গেছে। এ ভাঙ্গা দিয়ে পানি প্রবেশ করে ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের কয়েক শত পরিবার পানিবন্দী ছিল ভয়াবহ অবস্থায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, উক্ত ভাঙ্গা বাঁধ সংলগ্ন ছালে আহমদ দফাদার বাড়ির বেশ কিছু ঘর ভেঙ্গে পড়েছে। অনেকে কাঁচা ঘরে হাঁটুসম কাঁদা। ঘরে ফিরে অনেকে পরিস্কারের মধ্যে দিয়ে বসবাসের উপযোগী করছেন।
উক্ত বাড়ির মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে প্রবল স্রোতে পানি এসে আছড়ে পড়ে তাঁর বসতভিটায়। এরপর পানির উচ্চতা শুধুই বেড়েছে। দিদার বলেন, ‘হু হু করে ঘরে ঢুকেছে হালদার পানি। কিছু বুঝে উঠার আগেই টিনের বাড়িটি ভেঙে পড়েছিল। গায়ে পড়নের কাপড় নিয়ে কোনমতে জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসি।
এ এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম, মিনাআক্তার,আলমগীর,জসিম,মোহাম্মদমোহাম্মদ ফারুক,রুজি আকতার,মোহাম্মদ ইয়াছিন নিজেদের করুণ চিত্র তুলে ধরে বলেন,দেশের প্রধান উপদেষ্ঠাসহ কয়েকজন উপদেষ্ঠা আমাদের হাটহাজারীর। আমরা কিছু চাইনা, আমরা চাই টেকসই বাঁধ।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হালনার তীর রক্ষায় ব্লক বাঁধ দেওয়া হলেও হালদাপাড়ে কোনো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বাঁধের বিষয় নিয়ে আলেচনা হলেও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীর প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহাগ তালুকদার বলেন, গত ৫০ বছরে হালদা নদীর পানি বিপদসীমার সর্বোচ্চ ১১০সে.মি উপরে প্রবাহিত হয়েছে। নাজিরহাট পুরাতন ব্রীজের পশ্চিমে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২০২১ সালে উক্ত স্থানসহ হালদার বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বেড়িবাঁধ হওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় ঝামেলার কারণে সেটি হয়নি। আবারো প্রতিরোধী বাঁধ স্থাপন করলে সেটিও স্থায়ী হবেনা, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই আমরা চেষ্টা করবো হালদার বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের।