ফিচার

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি তাঁর সাফল্য অর্জনে

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ফটিকছড়ি: শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি তাঁকে। অদম্য ইচ্ছে শক্তি ও লক্ষ্যে অটুট থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেছেন সাইকা আসমা সানমুন।

গত রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সমাপনী বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হলে তার এ সাফল্যের কথা জানাজানি হয়। এরপর থেকে সবাই তাকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। আসমা চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী।

অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোর থাকলে যে কতদূর যাওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন ৩৬ ইঞ্চি উচ্চতার ২৫ বছর বয়সী আসমা।

তার সাফল্যে খুশি পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীসহ কলেজের শিক্ষকরাও। আসমার বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের পূর্ব পাশে প্রফুল্ল ডাক্তার বাড়িতে। বাবা আবু সালেহ চৌধুরী পেশায় একজন ব্যবসায়ী। মা মাজেদা বেগম তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।

মেয়ের সাফল্যের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওর এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেনি সে। এই সবকিছুর জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে আমাদের।

তিনি বলেন, আগে ইচ্ছা ছিল তার পড়াশোনা শেষ করানো আর এখন একমাত্র ইচ্ছা মেয়ের একটা ভালো চাকরি হোক। আমাদের অবর্তমানে সে নিজেকে নিজে চালিয়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করুক। অনেকে আড়ালে হাসি-ঠাট্টা করেন বলে তার আক্ষেপ।

সাইকা আসমা জানান, এই অনার্স ডিগ্রি অর্জনের পেছনে আমার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আম্মু-আব্বু। তারা আমার বেঁচে থাকার শক্তি। শত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে আম্মু-আব্বুর অনুপ্রেরণায় আমার এতদূর আসা সম্ভব হয়েছে। প্রচুর সমস্যাকে দূরে রেখে আব্বু-আম্মু আমার পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে গ্রাম ছেড়ে অচেনা ব্যস্ত নগরীতে আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে পেরেছিলাম। আমার আব্বু এতোটাই সাপোর্টিভ আমার পড়াশোনার জন্য, আম্মুকে বাসায় সকল কাজ ফেলে আমাকে কলেজে আনা নেয়ায় দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে কখনো আব্বুকে ছাড়া এলাকার বাহিরেও যাওয়া হতো না, সেই অবস্থায় আমি আর আম্মু কলেজে যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম শহরে একা যাতায়াত করেছি।

সাইকা বলে, জীবিকার তাগিদে আব্বু সাথে থাকতে না পারলেও আমার আব্বুর পূর্ণ সাপোর্টই আমার শক্তি। কলেজে আসা যাওয়ায় আমাদের প্রায়ই ১২ ঘণ্টা লেগে যেতো। সকাল ৬টায় বের হলে রাত ৯টায় বাসায় ফিরতাম। আমি ক্লাস এবং পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আমার আম্মু ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার জন্য বাহিরে অপেক্ষা করতো।

আমার সহপাঠীরা আমাকে বলতো, আন্টি যে তোমাকে নিয়ে এভাবে সারাদিনের জন্য চলে আসে বাসার কাজ কে করে? আসল বিষয়টা হল- বাসার সকল কাজ শেষ করে আম্মু আমাকে নিয়ে কলেজে আসতো, আবার বাসায় ফিরে বাকি সব কাজ সারতো। শত পরিশ্রমের পরও আমার আম্মুর চোখে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ছিল না। আমার স্বপ্নময়ী আম্মু। আমার এ সাফল্য আমার নই, আমার আম্মু-আব্বুর। সাইকা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মত শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সমাজে নিচু চোখে দেখা হয়।

শিক্ষিত মানুষেরা এটি আরো বেশি করে। কেন আমার মধ্যে কি এমন আছে যে এভাবে দেখতে হবে? আমরা যারা শিক্ষিত হয়েছি সরকার তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করুক এবং যারা শয্যাশায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধী আছে তাদেরকে আমাদের দেয়া ভাতা দেয়া হোক।

আমি বলছি না আমাকে ক্যাডার হতে হবে, আমার যে সীমাবদ্ধতা আছে তার ভিতরে থেকেই তো কাজ করতে পারি। তাও অনেকে বলে আপনার সাথে কাজ করতে আমাদের সমস্যা হবে। প্রতিবেশি ফারহানা বলেন, আমরা দেখেছি কি পরিমাণ কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে সাইকার বাবা-মা তাকে বড় করেছে। আজকে এ পর্যন্ত আসার পেছনে তাদের বড় অবদান।

নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তো আছে, তাকে এ সাফল্য লাভের জন্য অগ্রাহ্য করতে হয়েছে সমাজের নানা রকম প্রতিবন্ধতাকেও। আমরা অনেক সময় তাকে নিয়ে বের হলে লোকজনকে নানারকম কটু মন্তব্য করতে দেখেছি। এটা দেখে মানুষ হিসেবে আমরাও লজ্জিত হতাম। সাইকা স্নাতক পাস করেছে, এখন আশা- তার যেন একটা ভালো চাকরি হয়।

Please follow and like us:

Related Articles

Back to top button