অক্সিজেন ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার এই তো সময়
ফজলুর রহমান:: এই লেখাটি আপনি চারদেয়ালের মাঝে পড়বেন এমন তো কথা নেই। খোলা আকাশের নিচেও তো পড়তে পারেন। তবে দেখুন, রোদমাখা মাথায়ও কিন্তু পড়তে পারবেন না, আলোর ভেলকি আসবে।কিন্তু একটু সবুজ ছায়ায় গেলে আয়েশে চোখ বুলিয়ে যেতে পারেন। এইখানেই তো আজকের ম্যাজিক! যে বৃক্ষতলে আপনি আছেন, ভেবে দেখুন, কেউ অনেক দিন আগে সেই বৃক্ষ লাগিয়েছিলেন! কেউ কাজটি করে গেছেন বলেই আপনি আজ উপকৃত হলেন। এজন্যই হয়তো টমাস ফুলার বলেছেন, “যে বৃক্ষ রোপণ করে, সে নিজেকে ছাড়াও অন্যকে ভালবাসে।”
গাছ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করেছেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী। তারা জানান, ‘গাছপালা আমাদের রোগ ব্যাধির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করে।’ বিজ্ঞানীরা নিউইয়র্ক শহরের ওপর সমীক্ষা করে জানান, ‘গাছপালা শোভিত রাস্তার পাশে শহরের জীবনে অভ্যস্তদের হাঁপানী ও শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় কম।’
এই বৃক্ষ বা গাছকে অ্যালবার্ট সোয়েইজার দেখেছেন এভাবে ”কখনও বলবেন না যে পৃথিবীতে আর সুন্দর কিছু নেই। গাছের আকার, পাতার কাঁপুনিতে আপনাকে অবাক করার মতো কিছু আছে ।”
অন্যদিকে গাছের বিনাশকে স্যার পি.স. জগদীশ কুমার কিভাবে নিয়েছেন পড়ুন, “গাছ কাটা আপনার নখ কাটার মতো নয় তবে শ্বাস কাটানোর মতো।”
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার অন্যতম প্রভাবক হলো গাছপালা। সবুজে-শ্যামলে এই পৃথিবীকে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃক্ষরাজি। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। আদিকাল থেকেই মানুষের জীবন ছিল অরণ্যনির্ভর। এখনও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষ আমাদের নানা কাজে লাগে। অর্থনীতিতেও রয়েছে বনাঞ্চলের অপরিসীম ভূমিকা।
বলা হয়ে থাকে যে, যদি তুমি জানো আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি গাছের চারা রোপণ কর। আরো বলা হয়, যেই দেশে নাই তরু, সে দেশটা আসলেই মরু।
ইসলাম ধর্মমতে, কেউ যদি একটি ফল গাছ রোপণ করে এবং সে গাছের ফল পশুপাখি কিংবা মানুষ খায় এমনকি চুরি করেও খায় তবুও সে গাছের মালিক সদকার সওয়াব পায়। কেউ গাছ রোপণ করে মারা গেলে তিনি মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পেতে থাকেন এর বিনিময়ে।
গাছের অনেক উপকার:
গাছ গ্রিন হাউস প্রভাবকে প্রশমিত করে, মাটিতে জৈবপদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে, বহুমুখী খাদ্যের জোগান দেয়, বিশুদ্ধ বাতাস দেয়, দূষিত বাতাস শোষণ করে এর বিষাক্ততা থেকে জীবজগৎকে রক্ষা করে, ওষুধের উপাদান সরবরাহ করে, জ্বালানি, খুঁটি ও গোখাদ্যের জোগান দেয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমিত করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়, চিত্তবিনোদনের উৎস হিসেবে কাজ করে, আসবাবপত্রের জন্য কাঠ সরবরাহ করে, মানুষের আপদকালে বীমা তুল্য কাজ করে, লবণাক্ততা কমায়। তাছাড়াও গাছ অক্সিজেন তৈরি করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয়ভাবে প্রয়োজন; বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল বিশুদ্ধ রাখে; মাটির বিষাক্ত পদার্থ ও মাটির অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ শুষে নিয়ে মাটিকে পরিষ্কার রাখে; বাতাস পরিষ্কার রাখে, বাতাসের ধূলিকণা ধরে নির্মল রাখে, তাপ কমায় এবং বায়ু দূষণকারী কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, শোষণ করে; ছায়া দেয়, মায়া দেয় এবং আবহাওয়া ঠান্ডা রাখে; মাটির ক্ষয় রোধ করে। গাছের শিকড় মাটিকে বেঁধে রাখে এবং গাছের পাতা বাতাসের গতি ও বৃষ্টির গতিকে দমিয়ে রাখে, যা মাটির ক্ষয়রোধে সহায়তা করে; যখন আবাসন গৃহে সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়, তখন তার মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তাই গাছ আবাসন সম্পদের মূল্য বাড়ায়; মাটিতে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে; মাটির ভেতরে পানির উচ্চতা বাড়াতে সাহায্য করে; প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুম-লে যে পানি ছাড়ে তাতে পরিবেশ শীতল থাকে, মেঘ ও বৃষ্টির সৃষ্টি হয়; আমাদের বিভিন্ন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে এবং বিভিন্ন এলাকা মরুময় হয়ে যাচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বাড়ছে, বাতাসে জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মেরু অঞ্চল, এন্টার্টিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, প্লাবন, দেরিতে বৃষ্টি হচ্ছে।
একটি গবেষণায় দেখা যায়, একটি গাছ ১ বছরে আমাদের যা দেয় তা হলো ১০টি এয়ারকন্ডিশনার সমপরিমাণ শীততাপ তৈরি করে, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে এবং ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। ১ গ্রাম পানি বাষ্পীভবনে ৫৮০ ক্যালরি সৌরশক্তি ব্যয় হয়। ১টি বড় গাছ দিনে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। ১ হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি অক্সিজেন দেয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকালে। ১টি মাঝারি আকৃতির আমগাছ ৪০ বছরে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের অক্সিজেন তৈরি করে। ৫ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি থাকলে এলাকার ৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যায়, ভূমিক্ষয় রোধ এবং বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায়। বৃক্ষরাজি ৮৫-৯০% শব্দ শোষণ করে, শব্দ দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক প্রায় ২৫০ গ্রাম সবজি এবং ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। জানা যায়, মানুষের মেধা বিকাশের শতকরা ৪০ ভাগ হয়ে থাকে মাতৃগর্ভে এবং অবশিষ্ট ৬০ ভাগ বিকাশ হয়ে থাকে জন্মের ৫ বছরের মধ্যে। ভিটামিন-এ’র অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে অন্ধত্বের শিকার হয়। অথচ পুষ্টি জোগান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলগাছের রয়েছে ব্যাপক অবদান।
সাম্প্রতিক তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে গড়ে ২১ হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ১৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে। এজন্য প্রাকতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষ ও বনের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ বাড়াতে হবে গানিতিক হারে নয়, জ্যামিতিক হারে। এক কথায়, প্রাণে যদি বাঁচতে চান, বেশি করে গাছ লাগান। বরিস নেলসনের এই বাণীটি মনে রাখতে পারি “যারা গাছ বজায় রাখতে পারবে না, তারা শীঘ্রই এমন একটি পৃথিবীতে বাস করবে যা মানুষকে ধরে রাখতে পারে না।” তাই আসুন, এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে জীবন রক্ষাকারী পরম বন্ধু গাছ লাগাই।
বিটিভিতে এক সময় প্রচারিত সুদক্ষ অভিনেতা আবুল খায়ের-এর একটা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের কথাগুলো ছিল এরকম!
-সব গাছ কাইটা ফালাইতাসে। আমি ওষুধ বানামু কি দিয়া?
: কি গো কবিরাজ, কি খোঁজতাছেন?
-আইচ্চা, এইখানে একটা অর্জুন গাছ আছিলো না?
: আছিলো, কাইট্টা ফালাইছি।
-এইখানে একটা শিশু গাছ আর ঐ মাথায় একটা হরতকী গাছ?
: আছিলো, কাইট্টা ফালাইছি।
-আপনের গাছ?
: হ। টেকার দরকার পড়ছে তাই বিক্রি করছি।
-গাছ লাগাইছিলো কে?
: আমার বাবায়।
-আপনি কী লাগাইছেন?
: আমি কী লাগাইছি?
-হ, ভবিষ্যতে আপনার পোলারও টেকার দরকার হইতে পারে..।
আবুল খায়েরের শেষ কথাটা ছিলো: ‘এক-একটা গাছ, এক-একটা অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি।’
চলুন, ঘরে ঘরে গড়ে তুলি একাধিক অক্সিজেন ফ্যাক্টরির মালিক।
লেখক: ফজলুর রহমান, রচনা সাহিত্যিক এবং উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।