অতীতে পিছিয়ে থাকা নোয়াপাড়া কলেজ আজ পরিবর্তনের এক আলোকবর্তিকা
সালসাবিল করিম চৌধুরী::
মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্মভূমি রাউজানে গড়ে উঠেছে নোয়াপাড়া কলেজ। সবুজের সমারোহে থাকা শান্ত-সুন্দর এই কলেজ ক্যাম্পাস।পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা প্রতিবেশ এখানে। তবে অতীতে কেমন জানি, ঝিমিয়ে ছিল এই কলেজটি। এখন সেই দিন আর নেই। এখন কলেজটি হয়ে গেল উন্নয়ন আর অগ্রসরতার প্রতীক। নানা জায়গায় পরিচিতি পাচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা হিসেবে।
কলেজটির এই অসাধারণ পরিবর্তন আর অগ্রযাত্রার মূলে আছেন আমাদের প্রিয় অভিভাবক, রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাননীয় চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনের মাননীয় এমপি , আধুনিক, গ্রিন, ক্লিন এবং পিংক রাউজানের রূপকার, একটি অশান্ত জনপদকে শান্তিময় করার মহানায়ক জনাব এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী।
নোয়াপাড়া কলেজের অবকাঠামো, লেখাপড়ার সিস্টেম, প্রতিষ্ঠানের প্রতি কলেজ পরিবারের দায়বদ্ধতা সবকিছুতেই অসাধারণ উন্নতি আমরা দেখেছি এই নিবেদিনপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যাদুকরী স্পর্শে।এখানের প্রতিটি স্থাপনা, প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি ফুল যেন এমপি মহোদয়ের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে।
এখানে যোগদান করা সম্মানিত শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা মেনে চলে এমপি মহোদয় এর মহামূল্যবান এই উপদেশ “Every great dream begins with a dreamer. Always remember, you have within you the strength, the patience, and the passion to reach for the stars to change the world.”
এরইপ্রেক্ষিতে যখন কোন শিক্ষক এই কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তখনই তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে আপন ভাবতে শিখেন।এরফলে সকলে আত্ননিয়োগ করেন কিভাবে আরো নতুনত্ব আনা যায়, কিভাবে শিক্ষা, গবেষণা, উদ্ভাবন তথা উন্নতিতে কিভাবে আরো গতি আনা যায়। শিক্ষকগণের উপরে মাননীয় এমপি জনাব এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর সদয় নির্দেশনা এবং আস্থার ফসল হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রা নানা ক্ষেত্রে প্রসারিত হচ্ছে।
অত্র প্রতিষ্ঠানের সভাপতি থাকাকালে এমপি মহোদয় একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনায় বলেন, “A Good Teacher, A Good Governance, A Good Policy and A Good Administration can build a perfect Educational Institution.”
মাননীয় এমপির দেখানো পথে টেকসই ও গুণগত উন্নয়ন-অগ্রতির পথে এগিয়ে যেতে সকলে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ক্লাসের একটি চিত্র বলি। আমাদের ক্লাসে জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণের দীক্ষাও দেয়া হয়। এরফলে ছাত্রছাত্রীরা জেন্ডার বৈষম্য থেকে দূরে থাকে। বিভিন্ন সেবামূলক কাজে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত রাখা হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রোভার টিম চালু আছে। চালু হয়েছে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ। এই পরিষদ নৃত্য, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, উপস্থাপনা প্রভৃতি শিখিয়ে শিক্ষার্থীদের শিল্প-সাহিত্যমনা হিসেবে গড়ে তুলছে। পাশাপাশি দাবা, ক্যারম, লুডুসহ নানা ইনডোর গেইমস এর অবারিত সুযোগ আছে সকলের জন্য।
শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া হয়। আত্নকর্মসংস্থানের নানা উপায় তাদের সরেজমিনে দেখানো হয়। যেমন বিভিন্ন খামার বাড়িতে নিয়ে হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগলসহ গবাধি পশু-পাখি লালন-পালন শেখানো হয়। পরিদর্শনে দেখানো হয় বায়োগ্যাস তৈরি পদ্ধতিসহ কৃষির নানা কাজ ও ব্যবহার।
আধুনিক কর্মমুখী শিক্ষার সৃন্দর পরিবেশ বিরাজমান এই কলেজে। এখানে ফটোগ্রাফি, এডিটিংসহ নানা ডিজিটাল কনটেন্ট নিয়ে হাতে-কলমে শেখানো হয়। এ কাজে সকলেই সহযোগিতা করেন।
এখানে সেলাই প্রশিক্ষণের সুযোগও রাখা হয়েছে। আনন্দের কথা এ্ই যে, এই প্রশিক্ষণের ফলে অনেক শিক্ষার্থী এখন আত্ননির্ভরশীল। এর ফলে বাল্যবিবাহও কমে গেছে বলে অনেকে জানিয়েছেন।
রান্না হলো আমাদের একটি আদিকাল থেকে চর্চিত একটি বিষয়। শিক্ষাথীদের এখানে রান্নার প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। এই বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ফলে তারা গৃহকর্মসহ বাণিজ্যিক কিংবা ক্যাটারিং কাজে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ পায়।
হস্তশিল্প ও কারুশিল্পের পাঠ দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। সুদক্ষ কাঠমিস্ত্রিরাও আসেন প্রশিক্ষণ দিতে। ফলে তৈরি হয় নান্দনিক হাতপাখা, শোপিস, ফ্রেম, কাঠের নানা সামগ্রী।
নানা দেশীয় উৎসবে সরব থাকে নোয়াপাড়া কলেজ ক্যাম্পাস। যেমন- বসন্ত উৎসব, পিঠা উৎসব, মেহেদী উৎসব , জাতীয় উৎসব ইত্যাদি। হরেক রকম উৎসবের পসরার মাধ্যমে আবহমান বাংলার লালিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা থাকে সকলের।
কলেজ পরিবারের সকলেই বৃক্ষবান্ধব। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয় বৃক্ষরোপনে। এছাড়া বৃক্ষের পরিচর্যাও শেখানো হয় হাতে-কলমে। মালীরাও সুনিপুনভাবে বৃক্ষের যতন নেয়।
আমাদের বিজ্ঞান সহকর্মীর তত্বাবধাণে এখানে নানা গাছের সাথে নাম সংযুক্ত করা হয়েছে, যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা সহজে গাছগুলোর পরিচয় জানতে পারেন এবং অপরকেও চেনাতে পারেন।
এই কলেজ প্রাযুক্তিক দিক দিয়েও অনেক এগিয়ে। বায়োমেট্রিক এটেনডেন্স, সিসি ক্যামেরা, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, উন্নত ল্যাবরেটরি, আপডেট ল্যাপটপ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রজেক্টর, ডায়নামিক ওয়েবসাইট, সমৃদ্ধ ফেসবুক পেজ নিয়ে এগিয়ে চলছে এই প্রতিষ্ঠান।
এখানে আছে সুন্দর শিক্ষক মিলনায়তন। আছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি আরো আত্ন-উন্নতির সুযোগটাও তাই সকলের থাকছে।
একটি বিরাট খেলার মাঠে দাপিয়ে চলে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা বিরতিকালে কিংবা বিকেলে এই মাঠটি খেলার আনন্দে মেতে উঠে। অধ্যক্ষ মহোদয়ের সহায়তায় ক্রয়কৃত আধুনিক ঘাস কাটার মেশিন দিয়ে নিত্য পরিচর্যা করা হয় এই মাঠটিকে। আগে সেকেলে সিস্টেমে যেখানে দৈনিক শ্রমিক বাবদ ১৫০০ টাকা খরচ হতো এখন সে খরচের খাতায় উঠছে ৩০০ টাকা কেবল!
কলেজের একটি সুপ্রশস্ত, পরিকল্পিত পুকুর সকলের নজর কাড়ে। সুন্দর ঘাট, সুসজ্জিত আলোকায়ন এর ফলে এই পুকুরটি এখন সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে প্রাচীর গড়ে তোলায় আরো মনোহরা রূপ নিয়েছে পুকুরটি। ফলে এখন সকলে নিরাপদে পুকুরে পা ফেলছে, উপভোগ করছে এই প্রাকৃতিক আনন্দধারা। সুপেয় পানির জন্য পাশাপাশি একটি নলকূপের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
পরিবর্তনের আরেকটি দিক হলো সাইন্স ল্যাবের আধুনিকায়ন। আধুনিক ল্যাব ইকুইপমেন্ট যুক্ত হয়েছে এখানে। পাশাপাশি কলেজ সভাপতি মহোদয়ের পদক্ষেপে ছয়টি বার্নার চালানোর গ্যাস সিস্টেম যুক্ত হয় এখানে। এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ উপকৃত হচ্ছে।
এইখানের সকাল সুন্দর। রাত বোধহয় আরো সুন্দর। ২০০টি আধুনিক ও পরিকল্পিত বাতি যখন জ্বলে ওঠে তখন কলেজের শোভায় নতুন মাত্রা লাভ করে। এইসব মনোরমা আলোর অপরূপা রূপ সকলের মন কেড়ে নেয়। অনেকে ছবি তুলে ধারণ করে রাখে স্মৃতির পাতায়।
এই কলেজের রয়েছে সুন্দর স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত একটি মসজিদ। যেখানের মাইকে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। এখানের শিক্ষার্থীসহ আশেপাশের প্রতিবেশীরাও এখানে ছুটে আসে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে- যা দেখে বেশ ভালো লাগে।
সকল কাজের মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তা হলো দেশপ্রেম জাগ্রত করার মাধ্যমে সকালের সূচনা ঘটানো। রোজ সকালে সাউন্ড সিস্টেম সহযোগে জাতীয় সংগীত গেয়ে উঠা আমাদেরকে এখন অন্যরকম আত্নতৃপ্তি দেয়।
আমাদের প্রিয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো আমাদেরই আত্নপরিচয়ের ধারক ও বাহক। একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা দেখানো পথে হেঁটে এই নোয়াপাড়া কলেজ এখন জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এই অর্জনের ভাগিদার এই কলেজ পরিবারের সকলে। আগামী দিনে এমন সাফল্য আরো বিস্তৃত করতে আমাদেরকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে হবে।
পরিশেষে, ব্যাডেন পাওয়েলের কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, “ পৃথিবীকে যেমন পেয়েছি, তারচেয়েও ভালোভাবে রেখে যেতে চাই।”
লেখক: সালসাবিল করিম চৌধুরী।
প্রভাষক, ইংরেজি, নোয়াপাড়া কলেজ
রাউজান , চট্টগ্রাম
এবং কবি ও প্রাবন্ধিক।