বুক রিভিউ
বুক রিভিউ
বইঃ যদ্যপি আমার গুরু
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশনীঃ মাওলা ব্রাদার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১১০
একজন আদর্শ শিক্ষক হলেন একজন পথ প্রদর্শক, একজন মেন্টর,একজন গুরু। সর্বোপরি ভালো মানুষ তৈরির কারিগর। যিনি শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানপিপাসা জাগিয়ে মনের সুকুমার বৃত্তিগুলো পরিচর্যা করে শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষে পরিণত করেন। শিক্ষককে থাকতে হয় সবসময় জ্ঞান অনুশীলনের মধ্যে। একই বিষয় পড়ালেও নতুন নতুন জিনিস দিতে হয় ছাত্রদের মধ্যে।
ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীরও শিক্ষকের প্রতি থাকবে গভীর শ্রদ্ধাবোধ। একজন শিক্ষককে হতে হবে বজ্রের মতো কঠোর আবার কুসুমের মতো কোমল। সেই শিক্ষকই পারে নিজের বিশ্বাস, আদর্শ,দর্শন ছড়িয়ে দিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে । আমাদের সমাজে তো ডিগ্রি না থাকলে গুরুত্ব দেয়া হয় না। দক্ষতার চেয়ে ডিগ্রিকেই প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি।
ছাত্রকে উৎসাহ দেয়া, অনুপ্রাণিত করা- এটাও শিক্ষককের বড় গুণ।
ঠিক সেই রকম একজন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার।
প্রথমেই বলে রাখি বইটি সম্পর্কে বলার যোগ্যতা আমার নেই।
তারপরও বইটি পড়ে আমি কী জানতে ও শিখতে পারলাম তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি আজকের ‘বুক রিভিউ’তে।
১১০ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটি বই কিন্তু এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরর জন্য হতে পারে জীবন্ত ‘জ্ঞানকোষ’। গোটা পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে রেনেসাঁ,শেক্সপিয়ার, ভারতবর্ষে ইতিহাস, ইউরোপীয় সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাবৎ নিরীক্ষা, মাক্স,লেনিন -সব কিছুতেই ছিল তাঁর পর্বতুল্য পান্ডিত্য। একজন শিক্ষককে কেমন হতে হয় তা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে না পড়লে বুঝা যাবে না।
তবে উনার সম্পর্কে জানার সুযোগটি করে দিয়েছেন যিনি তিনি হলেন এই গ্রন্থের লেখক আহমদ ছফা।
আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ যত দিন লোকে পড়বে, তত দিন এই মহান শিক্ষক বহাল থাকবেন আমাদের মনিকোঠায়। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন তাঁদেরকেই তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন জ্ঞানচর্চায়।
জ্ঞানপিপাসায় সদা তৃষ্ণার্ত মানুষটা সংসারী ছিলেন না। সাদাসিধে বলতে যা বোঝায়, তার চেয়েও সরল জীবন কাটিয়েছেন তিনি। তবে সে জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ছিল। তাহলো বই আর বই। তাই তাঁর জীবনকে আমরা সাদাসিধে হিসেবে নিতে পারি কিন্তু সাধারণ নয়!
অবাক করা বিষয় হলো এমন এক গুণী, অনাড়ম্বর, জ্ঞানসাধক মানুষটি কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। এমনকি সভা-সমিতিতে কথাবার্তা বলারও অভ্যাস ছিল না তাঁর।
প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাথে পরিচয় হওয়াটাই ছিল লেখকের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
রাজ্জাক স্যার লেখক আহমদ ছফাকে লেখার ব্যাপারে বলেন, “ লেখার ব্যাপারটি অইল পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো ব্যাপার। যতো বড় ঢিল যতো জোরে ছুড়বেন পাঠকের মনে তরঙ্গটাও তত জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকব। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন,নিজেরে জিগাইবেন যে-বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে,তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিস টা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন,ধইরা নিবেন,আপনের পড়া অয় নাই। কত সুন্দর সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন লেখককে।
‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটির প্রতিটি কথা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। রাজ্জাক স্যারের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন লেখককে। সেটা হলো, “ পড়ার সময় দরকারি অংশ টুকিয়ে রাখা। ”
তিনি শিক্ষক জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির কথা প্রায় সময় বলতেন। সেটি হলোঃ “ আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের
ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা, চাওয়া-পাওয়ার খবর আমাদের মতো লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়।আর এটাই হল শিক্ষক-জীবনের বড় ট্র্যাজেটি।” শিক্ষক হিসেবে একথাটি অন্তত মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন সত্যেন বসু, মোহিতলাল মজুমদার, অমিয় দাশগুপ্ত, প্রফেসর আবদুল হাইয়ের মতো মহান শিক্ষকদের সাহচর্য। লেখকের কাছে নিজের শিক্ষকের গুণগান গাইতে ভুলেন নি তিনি।
প্রফেসর আবদুল হাই সম্পর্কে তিনি বলেন, “ শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মহৎ।তিনি বলতেন, পাঁচ ‘ব’ তে শিক্ষক। তারমধ্যে লেখক ৪টি ‘ব’ খোলাসা করেছেন। বিনয়,বপু,বাচন,বাৎসল্য.তাহলে ভেবে দেখুন যে মানুষটি এত বড় মাপের শিক্ষকদের সাহচর্য পেয়েছেন তিনিই বা বড় হবেন না কেন?
“ রাজ্জাক স্যার আমার সঙ্গে কখনো আমার রচনার ভালোমন্দ কোনোকিছু আলোচনা করেননি। অন্যের মুখে শুনেছি, আমার লেখা তিনি পছন্দ করেন।”
লেখক অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন কিন্তু স্যার জবাবে বলেন, না বাবা আপনাগো লেখার ভালোমন্দ এখনও কইবার পারুম না। লেখার ক্ষমতা আছে লেইখ্যা যান।নিজের খুশিতে লেখবেন।অন্য মাইনষে কী কইব হেইদিকে তাকাইয়া যান কিছু লেখবেন না।” তিনি হয়তো লেখকের সামনাসামনি শুনাম করতে চাননি।
পরিশেষে স্যারের মুখের ভাষা, খাবার, পোশাকআশাক সবকিছুর মধ্যে যেন একজন খাঁটি বাঙালির ছাপ পরিলক্ষিত হয়ে উঠে।
বলতে গেলে নিজে কিছুই লিখে যাননি শুধুমাত্র সাহচর্য ও সংস্পর্শের মাধ্যমে কত তরুণের মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন উল্লেখ করার মতো না।
লেখক যদি তাঁর কাছে না যেতেন তাহলে উনার সম্পর্কে জানাটা হয়তো আমাদের আর হতো কিনা সন্দেহ থেকেই যায়।
সেটা হয়তো সৃষ্টিকর্তায় ভালো জানেন, লেখক আহমদ ছফাকে কেন নিয়ে গিয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সান্নিধ্যে।
ধন্যবাদ
শেখ বিবি কাউছার
প্রভাষক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ
রাউজান, চট্টগ্রাম।
koucherihc14@gmail.com