করোনাকালে আরো বেড়েছে ঘুমের মহামারী: সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যঝুঁকি
ফজলুর রহমান:: ১.“আমার একটা নির্ঘুম রাত/তোমার হাতে তুলে দিলেই/বুঝতেই তুমি/ কষ্ট কাকে বলে” –অল্প কথায় নির্ঘুম রাতের যাতনা তুলে ধরেছেন গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী। লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর ভরাট গলায় তা আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে। গুরু আজম খানও হাহাকারে গেয়ে গেছেন- ‘সারা রাত জেগে জেগে /কত কথাই আমি ভাবি।/পাপড়ি কেন বোঝে না? তাই ঘুম আসে না ‘। নচিকেতা চক্রবর্তী এর গানেও আমরা আর্তনাদ খুঁজে পাই-“দু’নয়নে অবিরত চেনা মুখ কতশত/ভিড় করে হয়ে যায় আয়না/ঘুম আসে না, ঘুম আসে না।” আর জলের গান তো সরাসরি ঘুমকে দোষ দিয়ে বলেছে, ‘ঘুম আসেনা ঘুমও স্বার্থপর।’
২.স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে ঘুম সম্পর্কিত কিছু চমকপ্রদ তথ্য জানানো হয়। এখানে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো।
“পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যে নিজের ইচ্ছায় দেরি করে ঘুমাতে পারে। অন্য কোনো প্রাণীর এই ক্ষমতা নেই। ঘুমের সঙ্গে ওজন বাড়ার সরাসরি সংযোগ আছে। যারা কম ঘুমায় তারা বেশি খায়। ফলে তাদের শরীরে লেপটিন নামের প্রোটিনের মাত্রা কমে। এই প্রোটিন চর্বি থেকে উৎপন্ন হয় আর শরীরে চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ক্ষুধা বাড়ে, ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে মানুষ সময় ভাগ করে ঘুমাত, এমনকি রাতের বেলাতেও! তারা কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমাত। তারপর ঘুম থেকে উঠে কাজকর্ম করে আবার ঘুমিয়ে যেত। ০.০৫ মাত্রার অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা যতখানি বাধাগ্রস্ত হয়, ১৬ ঘণ্টার বেশি জেগে থাকলেও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা একই রকম বাধাগ্রস্ত হয়।”
৩. ঘুম নিয়ে একটা সুন্দর সোমালি উপকথা রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, “সবচেয়ে দামি বিছানা সেটাই, যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে।” আসলেই, আরামে ঘুমানোর চেয়ে আনন্দদায়ক ব্যাপার জীবনে আর কি হতে পারে! ঘুম শরীর ও মনকে বিশ্রাম দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও বেশ কার্যকার।
গবেষণা তথ্য মতে, ঘুম মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ শরীরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। পরিমিত ঘুম হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি কমায়। শরীর সুস্থ রাখতে দৈনিক কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। তবে ঘুম আর ভালো ঘুমের মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য। ভালো ঘুম না হওয়ার প্রবণতা একটি গুরুতর রোগ। এটিকে কখনও অবহেলা করা উচিৎ নয় এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সুনিদ্রা মানুষের দেহ ও মন দুটিই সতেজ-সুস্থ রাখে। ভালো ঘুম হলে দেহের মেটাবলিক ও হরমোনাল অ্যাক্টিভিটি এবং মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে শান্তি-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় ও কর্মক্ষেত্রেও পারফরম্যান্স ভালো হয়। সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ঘুম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। আবার নিয়মিত ঘুমের ব্যাঘাত বা অনিদ্রা হলে তা একজন মানুষকে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ফেলে দিতে পারে, একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন যার কারণে একটি সুন্দর জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
৪.সাম্প্রতিক তথ্যমতে, নিদ্রাহীনতার ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যহানীর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এটাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ঘুমের মহামারি’ হিসেবে। ঘুমের মহামারির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার জন্য চাকুরী হারানো, আয় নিয়ে উদ্বেগ, ব্ল লাইট এফেক্ট (বাচ্চাদের মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া), পারিবারিক সহিংসতা ও কাজের ক্ষেত্রে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া, করোনা আতংক তৈরি হওয়া, মদ্যপান ও ধূমপান বেড়ে যাওয়া, যথাযথ ‘ঘুমের সংস্কৃতি না থাকা অর্থাৎ সময় মতো রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাবার বহুল প্রচলিত অভ্যাস না থাকা ইত্যাদি।
৫.বিশ্বের সবচেয়ে ঘুমবঞ্চিত মানুষদের তালিকায় দক্ষিণ কোরীয়দের অবস্থান উপরের দিকে। দেশটিতে ঘুমের ওষুধে আসক্তি চলে গেছে মহামারী পর্যায়ে। তারপরও অনেকেই একগাদা ওষুধ খেয়েও ঘুমোতে পারে না। এই নিদ্রহীনতা দেশটির মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশকে গ্রাস করেছে। রাজধানী সিউলের গ্যাংনাম জেলার ড্রিম স্লিপ ক্লিনিকের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জি-হিয়্যুন লি। তিনি বিবিসিকে বলেন, “তার কাছে প্রায়ই এমন সব মানুষ আসেন যাদের কেউ কেউ রাতে ২০টি পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খান। সাধারণত, বিছানায় গেলেই আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসবে না, একটু সময় লাগবে। কিন্তু কোরিয়ার মানুষ দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে চায়, তাই তারা ঘুমের ওষুধ খায়। তারা কাঁদতে থাকে। তবু অনেক আশা নিয়ে তারা এখানে আসে। এটা সত্যিই খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি।” ঘুমের ওষুধে আসক্তি দক্ষিণ কোরিয়ায় মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে। কোনও সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক হিসাবে এক লাখ কোরিয়ান ঘুমের ওষুধে আসক্ত। তবুও যখন তাদের চোখে ঘুম নেমে আসে না, তখন তারা ওষুধের ওপর অ্যালকোহলও পান করে, এতে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক মোড় নেয়। অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে উন্নতির পাশপাশি এসেছে অবসাদ এবং নিদ্রাহীনতা। দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণদের একটি বড় অংশ তাদের ঘুমের সমস্যা নিয়ে সাহায্য চাইছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই নিদ্রাহীনদের ঘিরেও দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি শিল্প গড়ে উঠেছে- ২০১৯ সালে এই ঘুম শিল্প ঘিরে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। সিউলে শুধু ঘুমের জন্য সহায়ক সামগ্রী নিয়ে একেকটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গড়ে উঠেছে। ঘুম আনতে সহায়ক বিছানার চাদর থেকে শুরু করে উচ্চমানের বালিশ, ভেষজ ঔষধ, টনিক- কী নেই সেখানে! পিছিয়ে নেই প্রযুক্তিও। ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা দূর করতে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সহায়তা। বছর দুয়েক আগে ড্যানিয়েল টিউডর নামক একজন ‘কোক্কিরি’ নামের একটি মেডিটেশন অ্যাপ চালু করেন- দাবি করা হয়, কোরিয়ার তরুণদের মানসিক চাপ দূর করতে সহায়ক সেই অ্যাপ।
৬.ভয়েস অব এমেরিকা সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যগত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা কোম্পানি ফিলিপস ১৩টি দেশের ১৩ হাজারের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আচরণ, সমস্যা, চিন্তাধারা এবং ঘুমের অভ্যাস নিয়ে জরিপ করেছে। ফিলিপস গ্লোবাল সার্ভের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের শতকরা ৭০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ করোনাকালীন সময়ে তাদের ঘুমের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। করোনাকালীন সময় থেকে ৩৭ ভাগ মানুষ অনিদ্রায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। আমেরিকান স্লিপ অ্যাসোসিয়েশনের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭ কোটি আমেরিকানের ঘুমের সমস্যা রয়েছে। আমেরিকায় শতকরা ৩০ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক ঘুমের সমস্যায় ভোগেন।
৭.স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া হলো এক ধরণের স্লিপ ডিজঅর্ডার। দুই ধরণের স্লিপ ডিজঅর্ডার আছে। একটাকে বলা হয় ডিসমনিয়া আরেকটা হলো প্যারাসমনিয়া। ডিসমনিয়া হলো, ঘুম না আসা, বেশি ঘুম আসা, অথবা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া। প্যারাসমনিয়া হলো ঘুমের ভেতর অস্বাভাবিক আচরণ করা। আমরা সাধারণত যেটাকে অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া বলে থাকি, এটি আসলে ডিসমনিয়া গোত্রের অন্তর্গত। ঘুমের এক ধরণের সমস্যা যা স্লিপ ডিজঅর্ডারের সাথে সম্পৃক্ত। নানান কারণে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ঘুমের জন্য শরীরে মেলাটনিন হরমোন নিঃসৃত হয়। সাধারণত রাত ৯টা-১০টা থেকে শরীরে মেলাটনিন হরমোন নিঃসরণ শুরু হয় এবং সকাল ৬টা-৭টার মধ্যে এর নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ক্রমাগত রাত জাগলে এবং দিনে ঘুমালে শরীরের এই সাইকেল এলামেলো হয়ে যায়। একে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় circadian rhythm sleep disorder. এটি অনিদ্রা রোগের একটি অন্যতম বড় কারণ। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে মাসে একদিন নিদ্রাহীন রাত কাটান সে ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। যদি কেউ প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন অনিদ্রায় ভোগেন সেক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সেটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। আর যাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা, তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলমান তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
৮.বয়স অনুযায়ী মানুষের ঘুমের প্রয়োজনীয় সময় ভিন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের পরামর্শ পত্র অনুযায়ী, ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের রাতে অন্তত ৯-১১ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৮-১০ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের রাতে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য ঘুমানো প্রয়োজন ৭-৮ ঘণ্টা। অনেকেই এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও সুস্থ থাকতে পারেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজি ও নিউরো সায়েন্সের প্রফেসর, ‘হোয়াই উই স্লিপ’ বইয়ের লেখক ম্যাথিউ ওয়াকার জানিয়েছেন, ঘুম কম হলে দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। ঘুম কম হলে নতুন স্মৃতি তৈরি হয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন ম্যাথিউ ওয়াকার। তিনি বলেন, ঘুম কম হলে মস্তিষ্কে ‘বিটা অ্যামিলয়েড’ নামের ক্ষতিকর প্রোটিন তৈরি হয়। অ্যালঝাইমার রোগের সঙ্গে এই প্রোটিনটির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীর মস্তিষ্ক থেকে বিটা অ্যামিলয়েড ও এ রকম অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করে থাকে। কাজেই ঘুম কম হলে অ্যালঝাইমার রোগ সৃষ্টিকারী এই প্রোটিনটি ও এ রকম ক্ষতিকর পদার্থগুলো মস্তিষ্কে জমা হবে। আর যত দিন যাবে, ডিমেনশিয়া তৈরি হবে। শরীরের ওপর ঘুম কম হওয়ার নানারকম প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, এর ফলে প্রজননতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। কম ঘুমের প্রভাব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপরও পড়ে। মাত্র এক রাত চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমালে শরীরের ক্যান্সারপ্রতিরোধী কোষগুলোর ৭০ শতাংশ মরে যায়। এভাবেই কম ঘুম তৈরি করে অন্ত্রের ক্যান্সার, প্রোস্টেটের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের মতো নানা ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা এতই বেশি যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেকোনো নাইট শিফটের কাজকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘুম কম হলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার ওপরও খারাপ প্রভাব পড়ে। গভীর ঘুম রক্তচাপের প্রাকৃতিক চিকিৎসক। কারণ গভীর ঘুমের সময় হার্টবিট রেট কমে আসে, রক্তচাপ নেমে যায়। তাই পর্যাপ্ত ঘুম না হলে রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। ঘুমের স্বল্পতা প্রাণঘাতী স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ২০০% বাড়িয়ে দেয়। ১.৬ বিলিয়ন মানুষের ওপর দুই বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, ডেলাইট সেভিং টাইম চলাকালে যখন মানুষের ঘুমের সময় এক ঘণ্টা কমে যায়, তখন হার্ট অ্যাটাকের পরিমাণ ২৪% বেড়ে যায়। টানা ১৬ ঘণ্টা নির্ঘুম কাটালেই মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা টানা না ঘুমিয়ে থাকলে কারো মানসিক ও শারীরিক অবস্থা মাতালের সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব কাটিয়ে সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন দিনে গড়ে আট ঘণ্টা ঘুম।
৯.অনেকেই ভোর চারটা থেকে ৬টায় ঘুমাতে যান। উঠেন ১২টা থেকে ২টার মধ্যে। এতে তিনি ঘুমান ঠিকই। কিন্তু সেই ঘুম রাতের ঘুমের সমান হয় না কিছুতেই। তিনি ঘুমাচ্ছেন তার নিয়মে। কিন্তু তাঁর সমস্ত শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড চলে প্রকৃতির নিয়মে। তিনি সঠিকভাবে ব্রেকফাস্ট করেন না। ফুড সার্কেল নষ্ট হয়। তার সারা দিনের কাজের সিস্টেমে গোলযোগ হয়। সূর্যের আলোর মাধ্যমে ভিটামিন ডি থেকে বঞ্চিত হন। শুধু তা–ই নয়, ভিটামিন এ, ই থেকেও বঞ্চিত হন। দিনে ঘুমিয়ে রাত জাগলে মুখের টোনিং নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডার্ক সার্কেল পড়তে পারে। মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন। ওজন বাড়তে পারে। তা ছাড়া রাতে ঘুমের যেমন পরিবেশ, দিনে অনেক ক্ষেত্রেই সেটি পাওয়া যায় না। তাই দিনের ঘুম রাতের মতো গভীর হয় না। ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, রাতে দিনের মতো হাঁটাচলা হয় না। কিন্তু জাংক ফুড, ইরিটেটিং ফুড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এসব কারণে রাতের ঘুমই সেরা। দিনে ঘুমানো মন্দের ভালো।
১০.মেডিকেল নিউজ টুডে সূত্রে জানা যায়, হতাশা ও আশাবাদ; মানব মনের এ দুই ধরনের অবস্থাই ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। হতাশায় ভোগা মানুষের নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেশি। এর বিপরীতে নিদ্রাহীনতায় ভোগার আশঙ্কা অনেক কম থাকে আশাবাদী মনের অধিকারীদের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের আরবান-শ্যাম্পেন স্কুল অব সোস্যাল ওয়ার্কের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. রোসালবা হার্নান্দেজের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ‘বিহেভিয়ারাল মেডিসিন’ জার্নালে নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আশাবাদী মানুষের হূদযন্ত্রের স্বাস্থ্য তুলনামূলক বেশি ভালো থাকে। নতুন এ গবেষণায় ঘুমের সঙ্গেও আশাবাদের ইতিবাচক সম্পর্কের দিকটি উঠে এসেছে। ৩২ থেকে ৫১ বছর বয়সী ৩ হাজার ৫৪৮ অংশগ্রহণকারীর ওপর চালানো এক জরিপের ভিত্তিতে এ গবেষণা চালানো হয়। করোনারি আর্টারি রিস্ক ডেভেলপমেন্ট ইন ইয়ং অ্যাডাল্টস (কার্ডিয়া) শীর্ষক এক জরিপে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের আশাবাদী মনোভাবের মাত্রা পরিমাপের জন্য বিশেষ কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছিল; যেগুলোর উত্তরের ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আশাবাদী মনোভাবের উপস্থিতি পরিমাপ করে দেখা হয়। ড. রোসালবা হার্নান্দেজ ও তার গবেষক দলের সদস্যরা দেখতে পান, আশাবাদী মানুষের নিদ্রাহীনতায় ভোগার শঙ্কা অন্যদের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কম।
১১.বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা খাতসংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তার এক বড় কারণ হয়ে উঠেছে নিদ্রাহীনতা। নানাভাবেই নিদ্রাহীনতা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর পরামর্শ রয়েছে। যেমন-তোশক বদলানো, নিয়মিত ব্যায়াম, টানা বিশ্রাম ইত্যাদি। এ তালিকায় নতুন আরেকটি পদ্ধতি যুক্ত করে দিয়েছে নতুন এ গবেষণা। সেটি হলো আশাবাদী থাকা।
আমরা জানি, ভোর হওয়ার ঠিক আগেই রাত সবচেয়ে অন্ধকার হয়। আরও জানি, সূর্য ডোবার সময়ে কিছুক্ষণের জন্য আকাশে ভোরের মত রং দেখা যায়, যাতে মানুষ আশা করে কাল আবার সকাল হবে। আমরা আশাবাদী হওয়ার ছবক নিতে পারি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর এই উক্তি থেকেও, “যদি তোমার সামনে হতাশার কালো পাহাড় এসে দাঁড়ায়, তুমি তাতে আশার সুড়ঙ্গ কাটতে শুরু করো।”
লেখক: ফজলুর রহমান,উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।