সাহস, দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের মান রাখতে হবে আমাদেরই!
শেখ বিবি কাউছার:: বিগত কয়েক শতাব্দীতে উন্নত দেশের প্রকৌশলীরা নির্মাণ সেক্টরে এমন সব প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। সেদিক থেকে আমাদের দেশের প্রকৌশলীরাও আর পিছিয়ে নেই।
আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা প্রমাণ করেছেন সুযোগ ও সাহস পেলে তাঁরাও বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে থাকবে।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, একেকটি সেতু কেবল একেকটি জনপদকেই যুক্ত করে না,সহজ করে দেয় মানুষের জীবনযাত্রা, বাঁচিয়ে দেয় মহামূল্যবান সময়। সম্প্রসারণ ঘটে পর্যটন শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের স্বপ্ন তথা গোটা বাংলাদেশের চোখ এখন এই পদ্মাসেতু ঘিরেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতীক পদ্মাসেতু। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো এই পদ্মাসেতু। যার দৈর্ঘ্য ৬. ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ যুক্ত হয়েছে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে। একই সঙ্গে চলবে রেল ও গাড়ি।
পদ্মাসেতু তৈরির মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হলো আমরা বাঙালিরাও পারি আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। কারণ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে যা এখনো সম্ভব হয়নি তাই করে দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
করোনা মহামারির সময় যখন গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক তখনও পদ্মাসেতুর কাজ চলমান ছিল।
ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত ‘ ডেইলি টাইমস ‘ (২ জুন, ২০২২) পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাব বলেন’ “ দেশের উন্নয়নে মূর্তিমান প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে তাঁকে হাটঁতে হয়েছে কিন্তু তিনি গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছেছেন। সেতুর নির্মাণের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা
করেছেন। ”
এক সময় আমাদের দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অবজ্ঞা করা হয়েছিল কিন্তু এখন সেই দেশের ঝুলিতেই (পদ্মাসেতু) রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্ব্র রেকর্ড।
এই সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিগুলো। পানিপ্রবাহের দিক থেকে বিবেচনায় খরস্রোতা পদ্মানদীর অবস্থান বিশ্বের আমাজন ( ব্রাজিল) নদীর পরেই। এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হলো বাঙালি চেষ্টা করলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে বড় বড় কাজ সমাধান করতে পারে। পদ্মা সেতু নির্মাণের পুরো কাজটাই ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। পদ্মা সেতু বিশ্বে যে কয়েকটি বিষয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে যা এখন পর্যন্ত কোন দেশ করতে পারেনি।
প্রথমত, পদ্মা সেতুর জন্য পাইল বসানো ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । খুঁটির নিচে সবোর্চ্চ ১২২ মিটার (প্রায় ৪০ তলা ভবনের সমান) গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব এসেছে চীন থেকে। যা বিশ্বে এখনো পর্যন্ত এটাই প্রথম। পদ্মা এতটাই খরস্রোতা নদী যে পানির স্রোতের সাথে নিচ থেকে এত বেশি পরিমাণ মাটি তুলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় যা ৬৫ মিটার বা ২১ তলা দালানের সমান। যার কারণে খুঁটি নিতে হয়েছে আরো গভীরে। এই জটিল কাজটি করতে গিয়ে এক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল পদ্মাসেতুর কাজ। তবে জটিল কাজটির সহজ সমাধান দিয়েছিলেন আমাদের দেশের প্রকৌশলী ও পদ্মাসেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী ও তাঁর দল। ।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের অন্যতম কারিগর ও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান। উল্লেখ যে, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে,তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেতু,পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। এছাড়াও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল,ঢাকা সাবওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলেও ছিলেন তিনি। পদ্মা সেতুর সম্পর্কে তিনি জানিছিলেন, এখানে বিশেষ এক পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে যা ‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ নামে পরিচিত । এরকম পদ্ধতি ব্যবহারের নমুনা বিশ্বে খুব একটা নেই। এ প্রক্রিয়ায় ওপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে কেমিক্যাল ( অতি মিহি সিমেন্ট বা মাইক্রোফাইন) নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটিকে শক্ত করে ঐই মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে পিলার। এসব সিমেন্ট আমদানি করা হয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। সেতু তৈরিতে এত মিহি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয় না। যা বিশ্বে বিরল।
দ্বিতীয়ত, পদ্মাসেতুর বিয়ারিংয়ের ক্ষমতা আরেকটি বিশ্বরেকর্ড। পিলার ও সেতুর নিচের অংশের পাটাতনের মাঝে রয়েছে ১০ হাজার টনের ‘ ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’। এত শক্তিশালী বিয়ারিং পৃথিবীর আর কোনো সেতুতে নেই। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। বিয়ারিংগুলো আনা হয়েছে চীন থেকে।
তৃতীয় রেকর্ডটি ছিল নদী শাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার ( ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনার হয়েছে। যা আরো একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান-ই-ইয়ান ‘ দিয়ে সেতুর ৪১টি ( প্রতিটি ১৫০ মিটার) স্প্যান বসানো হয়েছে। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩,২০০ টন। যা চীন থেকে আনা হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যামার পদ্মা সেতুতে ব্যবহার করা হয়েছে। যার ওজন ৩ হাজার ৫০০ টন।
এখানে যে পাথরগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার একটির ওজন এক টন। এ পাথর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়েছে। মাত্র ১৫ টুকরো পাথরে ভরে যায় একটি বড় ট্রাক।
এই সেতুর মূল অবকাঠামো কংক্রিট ও স্টিলের তৈরি। সেতুতে ব্যবহৃত স্টিলের উপকরণ প্রায় সবই আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। কিন্তু রড, সিমেন্ট আর বালুর মতো উপকরণ ছিল দেশীয়। সেতু বিভাগের হিসাবে, সেতুতে সিমেন্ট লেগেছে আড়াই লাখ টনের চেয়ে বেশি। রড ব্যবহৃত হয়েছে ৯২ হাজার টনের বেশি। বালু লেগেছে সাড়ে তিন লাখ টন। এর সবই দেশে উৎপাদিত।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য সোয়া চার কোটি লিটার ডিজেল পোড়ানো হয়েছে। বিটুমিন লেগেছে দুই হাজার টনের বেশি। নদীর তীর রক্ষায় ২৫০ কেজি ওজনের জিও ব্যাগ (যে কাপড়গুলো দিয়ে নদী ভাঙ্গন রোধ করা হয় এবং যেগুলো মেরিন ড্রাইভে ব্যবহার করা হয়) বসানো হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ। এগুলোর সবই বাংলাদেশ থেকে কেনা হয়েছে। দেশের তৈরি বিদ্যুতের ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় পৌনে তিন লাখ মিটার এবং পাইপ ১ লাখ ২০ হাজার মিটার।
বাংলাদেশসহ প্রায় ২০টি দেশের বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান ও কর্মীর মেধা-শ্রম এই সেতু তৈরিতে কাজ করেছে।
মূল সেতুর কাজে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত,লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য,বেলজিয়াম,নেদারল্যান্ডসসহ আরও অনেক দেশের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুর থেকে যখন ইউরোপে ট্রেন যাবে তখন পদ্মাসেতু হয়ে যাবে।
পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হলো। যে পরিচয় সম্মান, গৌরব, সফলতা ও সক্ষমতার।
ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষায় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শৈলী, হবে গবেষণাও। নতুন প্রজন্মের প্রকৌশলীদের জন্য এই এক অপার সম্ভাবনাময় গবেষণাক্ষেত্র।
আবার একটা ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, তাহলো, আমরা কি পারব বাইরের দেশের মতো পদ্মাসেতুসহ মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টার্নেল ইত্যাদি বড় বড় অবকাঠামোগুলো সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ রাখতে? নারীরা কি স্বাচ্ছন্দে ও নিরাপদে এগুলো ব্যবহার করতে পারবে দিন কিংবা রাতে?
বড় বড় অবকাঠামোগুলো সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই।
শেখ বিবি কাউছার
প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ
রাউজান, চট্টগ্রাম।