সুফিবাদীদের প্রাণশক্তি আল্লামা আজিজুল হক ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী:: কোন ক্রাইসিস মুভমেন্ট ক্রিয়েট হলেই সেটা থেকে পরিত্রাণের জন্য একজন পরিত্রাণকারী প্রেরণ করে জাতিকে সুপথ দেখান মহান আল্লাহ। বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য যেমন সালাউদ্দিন আইয়ুবি, হিন্দুস্থানে হেরার জ্যোতি যেমন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরি, সম্রাট আকবরের দ্বীনে ইলাহি থেকে মানুষকে হেফাজতের জন্য খোদা প্রদত্ত শক্তি যেমন মুজাদ্দিদে আলফে সানি, বাতিল অপশক্তির বিষদন্ত ভাঙতে যেমন ইমাম আ’লা হজরত, যখন প্রিয় নবীর সুন্নাত থেকে সরিয়ে ইয়াহুদী-নাসারাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরলপ্রাণ মুসলমানদের কাজে লাগাচ্ছে একদল ষড়যন্ত্রকারী, ইসলামকে ধ্বংস করতে মুসলমানদেরকেই যখন গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে, যখন নব্য তাওহিদের দোহাই দিয়ে শানে রিসালতকে ভূলুন্ঠিত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠছে, ঠিক সেই ক্রান্তিলগ্নে দ্বীনের হাহাকার থামাতে মহান আল্লাহ তাঁর হাবিবের উসিলায় সুন্নিয়ত ও বেলায়তের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আউলাদে রাসুল (দ.), ইমামে আহলে সুন্নাত, আউলাদে রাসূল (দ.), শহীইদে মিল্লাত, হযরতুলহাজ্ব আল্লামা গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আজিজুল হক শেরে বাংলা আলকাদেরী (রহ.)-কে মহান সংস্কারকরূপে প্রেরণ করেন।
গাউসুল আজম মাইজভান্ডারি (ক.) জীবদ্দশায় ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, আমার পরে একজন জামানার মোজাদ্দেদ ও আশেকে রাসূল (দ.) আগমন করবেন”। হুজুর গাউসে মাইজভান্ডারি ১৯০৬ সালে দুনিয়া থেকে পর্দা করেন আর সেই বছরই গাউসে মাইজভান্ডারি (ক.)’র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ইমাম শেরে বাংলার জন্মগ্রহণ করেন। রতগর্ভা হাটহাজারীর মেখল গ্রামের অলিয়ে কামেল মাওলানা সৈয়দ আবদুল হামিল আলকাদেরী (রহ.) ও বিদুষী পূণ্যময়ী রমণী সৈয়দা মায়মুনা খাতুনের ঘর আলোকিত করে আল্লামা সৈয়দ আজিজুল হক ইমাম শেরে বাংলার জন্ম। তিঁনি পিতৃ ও মাতৃকুল উভয় বংশধারায় সৈয়দ বংশীয়। ইমাম বাংলাদেশ হতে প্রাথমিক থেকে টাইটেল (মাস্টার্স) সম্পন্ন করে কুরআন সুন্নাহর উপর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ভারতের বিখ্যাত ফতেহপুর আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। অসাধারণ পান্ডিত্য ও ব্যুৎপত্তি অর্জনের মাধ্যমে দাওরায়ে হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি লাভ করেন বাবাজী। ফতেহপুর আলীয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালে অলৌকিকভাবে সাক্ষাৎ হয় ইলমে লাদুন্নি তথা গোপন রহস্যজ্ঞানের ধারক হযরত খাজা খিজির (আঃ)থর সাথে।
খাজা খিজির (আঃ) ইমামকে ¯েœহে আলিঙ্গন করেন এবং ৪টি হাদিসের দরস দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। যে সাক্ষাৎ ইমামের জীবনকে আমূল-পরিবর্তন এনে দেয়।ইমামের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। ছাত্রজীবন থেকে ইসলাম, দেশ, মানবতা ও সভ্যতার শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁর তেজোদ্দীপ্ত হুংকার পরিলক্ষিত হতে থাকে। খোদা ভীতি ও রাসূল প্রীতির সুউচ্চ মিনার ইমামে পাক কাবা শরীফের গিলাফের রঙ কালো বলে তিনি সম্মানের সাথে গাঢ় কাল লম্বা টুপি পরিধান করতেন। আদবের বরখেলাফের আশঙ্কায় কখনো কালো জুতা পড়তেন না।
উন্নত, অনুপম উত্তম চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এককথায় আপাদমস্তক নবীপ্রেমিক। নবীপ্রেমের প্রতিবিম্ব ইমাম শেরে বাংলা। পড়াশোনা শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে ইমাম সুন্নিয়ত রক্ষায় দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। নিজ গ্রাম মেখল ফকিরহাটে প্রতিষ্ঠা করেন এমদাদুল উলুম আজিজিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা। প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে সুন্নিয়ত প্রচার ও দ্বীনিশিক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিনত হয় এ মাদরাসা।
জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে হাটহাজারী জামেয়া আজিজিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া, চন্দ্রঘোনা তৈয়বিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া, ফতেহ নগর অদুদিয়া ও লালিয়ারহাট হামিদিয়া হোসাইনিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়াও বাংলার আজহার খ্যাত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া, সোবহানিয়া আলীয়া, কদলপুর হামিদিয়া মাদরাসাসহ সুন্নি প্রতিষ্ঠানগুলোর শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন শিক্ষাবিদ ইমাম শেরে বাংলা। সংগঠক হিসেবে ইমামের খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। জমিয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান নামক একটি সুখ্যাত সংগঠনের সদস্য হিসেবে সাংগঠনিক যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি এ সংগঠনের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। সুফিবাদী মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমানে এশায়াতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাথআত। মানবতার শত্রু বাতিল অপশক্তি কোনভাবেই ইমামের সাথে পেরে উঠছিল না। কী মাহফিল, কী তর্কযুদ্ধ, কী লিখনি! সবদিকে ইমামের বিশ্বাসই জয়ী। বিজয়ী ইমামের কণ্ঠরোধ তথা পৃথিবীতে থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার হীন ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকলো জঙ্গিগোষ্ঠী।
ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৫১ সালের ২জুন হাটহাজারীর খন্দকিয়া গ্রামে ইমামকে মাহফিলের দাওয়াত দিয়ে শহীদ করে দেওয়ার পর মহান রাব্বুল আলামিনের দয়া ও প্রিয় নবীর সদকায় জীবন ফিরে পাওয়া ছিলো ইমামের মকবুলিয়াতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নবীপ্রেমের উজ্জ্বল পুরস্কার। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। মসজিদ ও খানেকায় সীমাবদ্ধ থাকার জন্য দ্বীনের আবির্ভাব হয়নি। জীবনের প্রতিটি স্তরে ইসলামের যোগসূত্র প্রমাণের লক্ষ্যে সমাজ পরিচালনায় অবতীর্ণ হন ইমাম শেরে বাংলা।
সমাজসেবক ও বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ ইমাম শেরে বাংলা সুদীর্ঘ ১৭ বছর হাটহাজারী মেখল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ফুড কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সুবিচারক ও সাম্যের মূর্ত প্রতীক, দেশপ্রেমিক সফল চেয়ারম্যান ইমাম শেরে বাংলার ব্যাপারে উনার চিরশত্রু মুফতি ফয়জুল্লাহর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন তোমরা শেরে বাংলাকে ভোট দিবে, এই মূহুর্তে তাঁর মত সুবিচারক ও ন্যায় বণ্টনকারী বিশ্বস্ত কোন লোক পাওয়া বিরল”। ১৯৫৭ সালে ইমাম শেরে বাংলা হজ্জ পালন করতে পবিত্র সৌদি আরবে গমন করেন। ইতোমধ্যে মুনাফিক চক্র ইমামের বিরুদ্ধে সৌদি আরব সরকারকে অভিযোগ দিলে তিঁনি বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন। সাহসিকতাপূর্ণ অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে হুজুরের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা এবং উনার আক্বিদাসমূহ সত্য প্রমাণ করলে ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন সৌদি প্রশাসন।
হজ্জ ও প্রাণের মদিনা জিয়ারত শেষে রওজামুবারকের পাশে মা ফাতেমা (রা.)র মাজারে শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে পুলিশ বলে এখানে কারো মাজার নেই। ইমাম শেরে বাংলা বলেন আমার স্থির বিশ্বাস এটাই মা ফাতেমা তুজজাহারার পবিত্র মাজার। পুলিশ বিশ্বাস না করলে শেরে বাংলা মিশর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত কিতাব থেকে প্রমাণ দিলেন এটাই মা ফাতিমার মাজার। ইমামের এ তীক্ষ্ণ মেধা ও পা-িত্যপূর্ণ জ্ঞান এবং অসীম সাহসীকতার স্বীকৃতিস্বরূপ সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি সরকারের পক্ষে ইমামকে শেরে ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করে লিখিত সনদ প্রধান করেন।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে কাদিয়ানীরা মোনাজেরায় ইমামের অসীম জ্ঞানের কাছে মুহূর্তেই পর্যুদস্ত হয়ে গেলে সেখানে উপস্থিত বৃটিশ সরকার কর্তৃক ‘ফখরে বাংলাথ উপাধি প্রাপ্ত যুগশ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা আবদুল হামিদ (রহ) বাংলাদেশের সকল ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে ইমামকে শেরে বাংলা” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫৬ সালে ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে আবুল আলা মওদুদীর বক্তব্য চলাকালীন সিংহ শার্দূল বেশে বজ্রকণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া, কুমিল্লা আদালত ভবনে ছিদ্দিক আহমদকে পরাস্ত করাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইমামের মোনাজারার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এখনো লোকের মুখে বর্তমান।
সুন্নি মুসলমানদের পালনীয় দিবসসহ শরীয়তের কঠিন ও স্পর্শকাতর মাসয়ালার সহজ সমাধান দিতেন ইমামে পাক। আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন, প্রিয় নবী পাককে বড় ভাইয়ের মতো বলা, নবীর গায়েবকে অস্বীকার, মদিনার মুনিবকে নূর না মানা, হাজের নাজের অস্বীকার করা, নবী মোস্তাফার সম্মানিত পিতামাতাকে মুমিন না মানা, নবীর স্মরণ নামাজে আনার চেয়ে পশুর স্মরণ উত্তম, বাতিল সম্প্রদায়ের এহেন ইমান বিধ্বংসী বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করে সব বিতর্কিত মাসয়ালার সমাধান দিয়েছেন তিনি। আখেরি চাহার সোম্বা পালন, দ্বীনি কাজ করে হাদিয়া গ্রহণ, নফল নামাজ জামাতে পড়া এবং দাঁড়িয়ে সালাতু সালাম দেওয়ার ফতোয়া ছিল যুগান্তকারী। ইমাম শেরে বাংলা আউলিয়া কেরামের মাজার নির্মাণ ও ওরশ-ফাতেহার পক্ষে যেমন ক্ষুরধার ছিলেন। তেমনি ভন্ড নবী, ভন্ড অলী, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ছিলেন অগ্নিশর্মা। তিনি সদা বলতেন, আমি নবী অলী বিরোধীদের জন্য শানিত তলোয়ার। মুমিন মুসলমানদের মহান অভিভাবক ইমাম শেরে বাংলার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব দিওয়ান-ই আযীয ও মজমুআহ-ই ফাতাওয়া-ই আযীযিয়া এখনো সত্যান্বেষীদের পথ দেখিয়ে চলছে, আগামীতেও পথ দেখাবে নিঃসন্দেহে। আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ হিসেবে ইমামের ছিল জগৎ জুড়ে খ্যাতি।
আউলাদে রাসূল (দ.) ও গাউসুল আজম জিলানী (রা.)থর বংশধর বিশ্বনন্দিত সুফি সাধক আল্লামা সৈয়দ আব্দুল হামিদ বোগদাদি (রা.)-এর মুরিদ ও প্রধান খলিফা ছিলেন ইমাম শেরে বাংলা। হানাফি মাজহাব ও কাদেরিয়া তরিকতের অনুসারী ও প্রচারক ছিলেন তিঁনি। মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় ইমামে পাক সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের রূহ মোবারক হাজির করে সরাসরি আলাপ করতেন যা উনার জীবদ্দশায় কাজীর দেউড়ীস্থ বাসভবনে প্রতি বুধবার রাতে আউলিয়ায়ে কেরামের রূহানী কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রমাণ দিতেন। বর্তমান সময়ের প্রবীণ ওলামায়ে কেরাম ইমাম শেরে বাংলার অসাধারণ বেলায়তের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বের নন্দিত সুফি সাধক, বুজুর্গানে দ্বীন, আউলায়ায়ে কেরাম, যুগশ্রেষ্ঠ ওলমায়ে কেরামের সাথে ছিলেন ইমামের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। এদেশের ওলামায়ে কেরাম ও সুফিবাদী মুসলমানদের জীবনমান উন্নয়নে মুজাদ্দিদ ইমাম শেরে বাংলার অর্ধশত বছর আগের বিবিধ সংস্কারের সুফল জাতি এখনো ভোগ করে চলছে। দেশ জাতির গর্বের ধন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, সমাজসংস্কারক, সুন্নিয়তের মহান অভিভাবক, মুজাদ্দিদে জামান ইমামে পাক ১৩৮৯ হিজরির ১২ রজব, ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বুধবার দিবাগত রাতে ৬৩ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন।
জ্ঞানীরা ইমামের ৬৩ বছর বয়সের সংখ্যায়ও নবীপ্রেমের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবেন। প্রতি বছর মহান ১২ই রজব মিল্লাতের মহান রাহবার ইমামে পাকের ওরশ মোবারক মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।
কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
খতিব: একে,এম ফজলুল কবির চৌধুরী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।