শিল্প ও সাহিত্য

কল্পনা শক্তির শাসন

ফজলুর রহমান::

সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন,”কল্পনা শক্তি পৃথিবীকে শাসন করে।” আর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর মতে, “‘কল্পনা জ্ঞানের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ’।”

আসলেই কল্পনাশক্তি হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সকল সৃজন শক্তির উৎস ধারা। সকল প্রকার শক্তি, সব রকমের তথ্য ও শতকোটি তত্ত্বের মূলে লুকিয়ে আছে কল্পনাশক্তির। এই যে আমরা কেতাবি ভাষায় শুরুতে বলি, ‘মনে করি’, ‘ধরি’ এসব হলো কল্পনার প্রাথমিক বীজ। আর ‘আমি ইহারে পাইলাম’ কিংবা ‘ইউরেকা’ হলো কল্পনা শক্তির ফসল।

কল্পনা কি?
কল্পনা হলো স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা। এটা সৃজনশীল প্রতিচ্ছবি তৈরি করার ক্ষমতা হিসেবেও পরিচিত। এটা দেখা ও শোনা এর অনুরূপ এক সরাসরি অনুভব। সমস্যার সমাধানে জ্ঞানের প্রকৃত প্রয়োগে কল্পনা সাহায্য করে। এটি অভিজ্ঞতা ও নিয়মিত শিক্ষা একীভূত করার অবলম্বন হিসেবে কাজ করে।

কল্পনার কাজঃ

কল্পনাশক্তি হলো মহাজাগতিক বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। জগতের সবকিছু এর অন্তর্ভুক্ত। সৃজনশীল জীবন ধারার কথা ধরা যাক। একজন সৃজনশীল ব্যক্তি সে কবি হোক বা বিজ্ঞানী হোক বা রাজনীতিবিদ হোক, সে যে কোন ধরনের আন্তর্জাতিক ব্যক্তি হোক, তার গন্তব্যের পথে পৌঁছাতে হলে সর্বপ্রথম তাকে যে উপায় অবলম্বন করতে হবে সেটি হলো কল্পনাশক্তি। কল্পনাশক্তির নিখুঁত মাপকাঠিতে তাকে উত্তীর্ণ হতে হবে আগে। এরপর কর্ম দক্ষতা, কর্ম যোগ্যতা,কর্মগুণের সমন্বয়ে কল্পনাশক্তির বিকাশের পথে হাঁটতে হবে। এভাবেই সফলতার দ্বার উম্মোচিত হবে। যেখানে কল্পনার ব্যাবহার নেই, সেখানে তেমন কোন অগ্রগতিও থাকে না। কারো মধ্যে জ্ঞানের পাহাড় আছে, কৌশলের রাস্তা আছে, নানান দিক দর্শন আছে, কিন্তু কল্পনাশক্তি নেই, তাহলে সে যেন গভীর জঙ্গলের পথহারা পথিক। কল্পনাশক্তির ব্যবহার না জানা থাকলে কোনকিছু সফলতার মুখ দেখবে না।

কিভাবে গড়ে কল্পনা শক্তি?
আমাদের মস্তিস্কের কোষকে নিউরণ বলে। প্রায় এক হাজার কোটির মত নিউরণের বাস করে এখানে। একটি নিউরন অন্য একটি নিউরনের সাথে পেঁচিয়ে থাকে এবং একসন ও ডেনড্রাইভের মাধ্যমের একটির সাথে অন্যটির সংযোগ করে। এই সংযোগ যত বেশি হয়, মানুষ তত বেশি নতুন কাজ করতে পারে। আর মস্তিস্ককে ব্যস্ত রাখার কাজ হচ্ছে কোন জিনিস নিয়ে ভাবা এবং মনের মধ্যে সেটার একটা চিত্রকল্পের রূপ দেয়া। এতে করে সে সম্পুর্ন নতুন একটা বিষয় মনের মধ্যে এঁকে ফেলতে পারে। আর এই এঁকে নেয়ার মাধ্যমে গড়তে থাকে কল্পনা শক্তি। গ্রেটিস্ট ডট কম ওয়েবসাইট অনুসারে আমরা কল্পনা শক্তির কিছু উৎস কিংবা উপায় খতিয়ে দেখতে পারি।

১। সুদূরপ্রসারী ভেবেই দেখুন: গবেষণা বলছে, যখন সুদূরপ্রসারী বা কাল্পনিক কোন চিন্তা করি তখন আমাদের সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য বাড়ে।

২। সবুজ বা নীল বস্তুর দিকে তাকান: এই রঙ দুটো দৈনন্দিন জীবনযাত্রার গতি বাড়াতে সাহায্য করে বলে প্রমাণিত। গবেষণা অনুযায়ী, সেটাই স্বাভাবিক কেননা আমরা বেড়েই উঠি নীল আকাশ, সমুদ্র আর সবুজ গাছগাছালি দেখে। একটা প্লাস্টিকের গ্লোব কিনে টেবিলে রেখে দিতে পারেন। এরপর যখনি নতুন সমস্যায় পড়বেন, নীল-সবুজ গ্লোবের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখতে পারেন নতুন আইডিয়া আসে কি-না মাথায়!

৩। ব্যস্ত রাখুন দুটো হাতকেই: অনেকে হাত নেড়ে কথা বলেন। অনেকের কাছে আবার এটা বিরক্তিকর। যখন দুই হাত নেড়ে কোন কিছুকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন তখন অজান্তেই মস্তিষ্ক সে বিষয়টিকে বহু দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে থাকে। ফলে আপনার জন্যও বিভিন্নভাবে বিষয়টিকে অনুধাবন করা সহজ হয়। এরপর হাত নেড়ে কথা বলার সময় খেয়াল করে দেখবেন, দুটো কথা ঠিক বেশি বলতে পারছেন।

৪। একটু আলাদা বসুন: না এর মানে এটা নয় যে আপনাকে অসামাজিক হয়ে যেতে বলা হচ্ছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, অনেক মানুষের কোলাহলের মাঝে সব সময় নিজের মত করে ভাবার অবকাশ পাবেন না। মাঝে মাঝে তাই একটু তফাতে থাকুন।

৫। শুয়ে ভাবুন: গবেষণায় দেখা গেছে, বসে থাকার চাইতে শুয়ে শুয়ে নাকি মানুষের শব্দজট সমাধানের প্রবণতা বেশি। অর্থাৎ শুয়ে চিন্তা করলে মানুষের মাথা বেশি খোলে।

৬। পুনর্ভাবনা: আচ্ছা, একটা গোলাপে কি থাকে? চট করে বলে ফেললেন, কাঁটা। তাহলে নিশ্চিতভাবে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধির এই লেখাটা আপনাকে উৎসর্গ করেই। কারণ গোলাপে কাঁটার পাশাপাশি থাকে বৃতি, পাঁপড়ি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরাগরেণু প্রভৃতি। হ্যাঁ এভাবে ভাবতে শিখুন। কোন একটা ব্যাপারকে একদম সাধারণীকরণ করবেন না। ভাবুন পুনর্বার, বার বার।

৭। হাসুন: এটা করতেই হবে। আপনি যখন গোমড়া মুখে থাকেন তখন ক’জন আপনার কাছে আসে? আইডিয়ারাও তেমনি। মস্তিষ্কের যে অংশটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত, ইতিবাচক থাকলে তা অধিক সক্রিয় থাকে। মজার মজার স্মৃতি চিন্তা করে এক্ষুনি একটা বোকাহাসি দিয়ে নিন।

৮। বাইরে সময় কাটানো: ছোটবেলায় মাঠে খেলাধুলার স্মৃতি মনে আছে? চেষ্টা করুন বাইরে সবুজের মাঝে প্রতিদিন কিছুটা সময় কাটাতে। বড়বেলায় এই বা খেলার চেয়ে কম কী! এটা আপনার পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করবে, শরীরকে এনার্জিতে পূর্ণ করবে আর কল্পনাশক্তিকে দিবে নতুন মাত্রা।

৯। ঘুম: কোনো একটা সমস্যার জালে জড়িয়েই আছেন, টেনশনে অস্থির লাগছে, ব্যস বিছানায় গিয়ে একটা ঘুম দিন। সকালে উঠে হয়তো সমাধান পেয়েও যেতে পারেন। ঘুম আমাদের সারাদিনের স্মৃতিগুলোর পুনর্গঠনে সাহায্য করে, ফলে আমরা নতুন করে ভাবার সুযোগ পাই।

১০। কফি শপের আয়েশ: সবার ক্ষেত্রে এটা খাটবে না হয়তো তবু একটা গবেষণা দাবি করছে, কফি শপের মত মডারেট কোলাহলের জায়গাগুলো নাকি সৃজনশীল চিন্তার উদ্গীরণে সহায়ক। কফির ঘ্রাণ, চামচের খুটখাট ইত্যাদি শব্দগুলো মানুষকে একটু অন্য ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।

১১। কল্পচিত্র: যে কোনো কিছু করার আগেই কল্পনায় তাকে একটি ফ্রেমে রুপ দিবেন। একজন চিত্রশিল্পী যখন রঙ তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকেন, তার আগেই কিন্তু সে ছবিটাকে তিনি কল্পনার চোখ দিয়ে দেখে নেন।

১২। প্রত্যাখ্যান মোকাবেলা করা: ‘এক’ সংখ্যাটা কিন্তু একাই, তার পাশে কেউ নেই। একই কারণে এই সংখ্যাটাই সবচেয়ে শক্তিশালী আর অভিনব। কারো কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দমে যাবেন না। কারণ এর ফলেই আপনি এখন নব উদ্যমে আর নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাববেন।

কল্পনা শক্তি বাড়ানোর একটি অব্যর্থ মহৌষধ এর কথা বলেছেন আমাদের পল্লীকবি জসিম উদ্দীন। তিনি বইকে কল্পনাশক্তির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, ‘বই আপনাকে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ যে কোনো কালেই নিয়ে যেতে পারবে। যে দেশে আপনার কোনো কালেই যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বইয়ের পাতার রথ আপনাকে সে দেশেও নিয়ে যাবে।’

লেখক, রচনা সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং ডেপুটি ডিরেক্টর, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

 

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button