কুঁড়ে ঘরে থেকে করি শিল্পের বড়াই
ফজলুর রহমান::
দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন, “মানুষ তর্ক করে আর প্রকৃতি সৃষ্টি করে।” এই সৃষ্টিশীল প্রকৃতির জন্যই এই দুনিয়া এত সুন্দর। এই সদা সৃজনশীল প্রকৃতির পরতে পরতে আছে অপার সৌন্দর্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনের গভীর স্তরে প্রবেশ করে। তার ছোটো উপকরণ আনন্দ দেয় আর সম্মিলিতভাবে সৌন্দর্যবোধকে উজ্জীবিত করে।
প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-শ্রুতি-স্পর্শ-এর মধ্যে প্রবহমান আনন্দ ধারায় মানুষ সিক্ত হতে পারে চারপাশ থেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কথাটি ঘুরিয়ে নিকট সৌন্দর্য উপভোগীরা বলে উঠতে পারেন, ‘দেখা হলো চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া।’
আজ তেমন একটি সহজিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথায় থাকি। আমরা আজ একটি পাখির কথা বলি। দু’দিকে পাখা ছড়িয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখি দেখতে কার না ভালো লাগে? পাখির কলকাকলির দৃশ্যও সবসময় ভীষণ মুগ্ধকর।
এই পাখিদের বাসা তৈরির অসাধারণ সৃজনশীলতাও যেন প্রকৃতির অপূর্ব স্থাপত্যশিল্পের বহিঃপ্রকাশ। পাখির বাসার দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা যায় যে, এরা কত শ্রম, বুদ্ধি, ধৈর্য ও কৌশল খরচ করে একটি বাসা তৈরি করে।
কিছু পাখির বাসা নির্মাণশৈলী এতোটাই দারুণ যে, তা দেখে পাখির দ্বারা নির্মিত এটা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি ছোট্ট পাখি সুনিপুণভাবে দক্ষ কারিগরের মতো শুধু তার ঠোঁট ও পায়ের নখ ব্যবহার করে কিভাবে এতো সুন্দর এবং নিখুঁত বাসা বানাতে পারে! তাই পাখির বাসা অনেক প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদের কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম।
তেমন এক সুন্দরতম বিস্ময় হলো বাবুই পাখির বাসা। বাসার চেনার আগে বাবুইকে একটু জেনে নিই। এরা লম্বায় ১৪-১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮-২২ গ্রাম। খুব সুন্দর বাসা বোনে বলে বাবুই তাঁতি পাখি নামেও পরিচিত। বাবুই পাখিকে শৈল্পিক ইঞ্জিনিয়ারও বলা চলে। খুবই দৃষ্টিনন্দন এই পাখি। বিরল প্রকৃতিরও। গাঁও-গ্রামে তাল গাছ, নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ ও কড়ই গাছে তারা দল বেঁধে বাসা বাঁধে।
এবার জানি বাবুইদের বসতবাড়ির বিষয়ে। বাবুইদের বাসার গঠন বেশ জটিল। বাসার আকৃতি খুব সুন্দর। কয়েক প্রজাতির বাবুই একাধিক কক্ষবিশিষ্ট বাসা তৈরি করতে পারে। নিজের ঘর সাজাতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। এরা বেশ দলবদ্ধ প্রাণী আর কলোনি করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত।
বাবুই পাখির বাসা উল্টানো দেখতে কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ছাড়ায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গাও তৈরি করা হয়। অন্য দিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ থাকে। বলা হয় যে, বাবুই পাখি চালাকও কম নয়। কিছু বাবুই রাতে বাসায় আলো জ্বালাতে জোনাকি পোকা ধরে এনে বাসায় গুঁজে রাখে!!
বাবুই পাখি যত্ন করে তালপাতা, কাশবনের পাতা, খড়কুটো দিয়েই উঁচু তালগাছে, নারিকেল, কড়ই, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাসা যখন উঁচু তাল গাছে দোল খায়, তখন দারুণ লাগে। তাদের শৈল্পিক চিন্তা এতই প্রবল ঝড় কিংবা তুফানেও কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না।
বাবুই পাখির বাসা বুননের কাজটি যেন রবীন্দ্র বাক্যের মতো। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “অপ্রয়োজনের প্রয়োজনে শিল্পের সৃষ্টি। ” রবীন্দ্রনাথ শিল্প সৃষ্টিকে দেখিয়েছেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি তাগিদ হিসেবে। বাবুই পাখির বাসা এতো সুন্দর বুননে না হলেও তো চলতো। আর দশটা পাখির মতো একটা বাসা গড়লেই হতো। কোকিলের মতো কোন কোন পাখি তো বাসা না বানিয়েই অপরের বাসায় ভর করে জীবন পার করে দেয়! সেখানে বাবুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শিল্প তাগিদ হিসেবে যেন বাসাটি গড়ছে। বাবুই থেকে শিল্পবোধের শিক্ষা নেয়া যায় এখানে।
আপন ইচ্ছেমতো সৌন্দর্য পরিস্ফুটনে যে চিরায়ত আনন্দ আছে সে বিষয়টিও শেখা হয়ে যায়। রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় তা ফুল হয়ে ফুটেছে। এখানে বাবুই আর চড়ুই পাখির বাসা নিয়ে তর্কাতর্কি পড়ে জীবনমুখী পাঠ পাওয়া যায়। ছোটবেলাকার কবিতাটি ভেসে উঠুক এবার।
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
“কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই;
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা ‘পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।”
বাবুই হাসিয়া কহে- “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়;
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”
নিসর্গের কবি জীবনানন্দ দাশ আক্ষেপে লিখেছিলেন, ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের, মানুষের সাথে দেখা হয়নাকো তার…।’ আমাদের সাথে ওইসব জীবনেরও দেখা হোক। যেন পড়তে পারি বাবুই জীবন। যেন নিতে পারি শৈল্পিকতার সুধা। যেন চিনতে পারি স্বাধীনতার স্বাদ।
লেখকঃ ফজলুর রহমান, রচনা সাহিত্যিক এবং উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।