তুমি যতদূর পিছনে তাকাবে, ততদূর সামনে দেখতে পাবে
ফজলুর রহমান::
এক রাজা তার প্রজাদের পরীক্ষা করার জন্য রাস্তার মাঝখানে একটি বড় পাথর রাখলেন। রাজা সাহেব একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই পাথরটি কে প্রথম পাবে তা দেখতে শুরু করলেন। লোকেরা সেই রাস্তা দিয়ে গমনাগমন শুরু করলো। কিছু লোক পাথরটি দেখে পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলো। আর কিছু লোক রাজাকে গালি দেওয়া শুরু করল। তারা বলতে শুরু করে, “এ কেমন রাজা ? আমাদের রাস্তায় বড় বড় পাথর রেখে দিয়েছে, রাস্তাঘাটের কি অবস্থা!”
এরইমধ্যে এক কৃষক সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলেন। তার মাথায় একটি ঝুড়ি ছিল। ঝুড়িটি নীচে রেখে তিনি সেই পাথরের কাছে এলেন। পাথরটি সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। পাথরটি খুব ভারী ছিল। তাই এটি সরানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তিনি আবার চেষ্টা করে পাথরটি ধীরে ধীরে কিছুটা সরিয়ে দিলেন। অবশেষে কৃষক পাথরটি রাস্তার এক পাশে সরিয়ে দিয়ে পথ পরিষ্কার করলেন।
যখন কৃষক ফিরে এসে মাথার উপরে ঝুড়ি তুলার চেষ্টা করলেন, তখন তিনি লক্ষ্য করলেন যেখানে পাথর ছিল সেখানে একটি থলি রয়েছে। তিনি থলিটি খুলতেই দেখলেন সেটাতে একটি সোনার বিস্কুট এবং একটি চিঠি রয়েছে। সেই চিঠিতে লেখা রয়েছে, “আমি আপনার পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম এবং এটি দেখতে চেয়েছিলাম, কে এই সমস্যার পাথর সরিয়ে দেয় এবং সাফল্যের কাছাকাছি যেতে পারে।”
উক্ত গল্পটি অসাধারণ অনুপ্রেরণার। সকলের জীবনে এরকম অনেক পাথরের বাধা আছে। কেউ যদি সেই বাধাগুলি সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তবে তার জন্য অনেক সাফল্য অপেক্ষা করছে। আর যদি আপনি চেষ্টা না করে থাকেন, তবে চেষ্টা করতে শুরু করে দিন। আজ নয়তো কাল, কাল নয়তো পরশু সমস্যারূপক পাথরটি অবশ্যই চলে যাবে এবং আপনি সাফল্য অর্জন করতে পারবেন। আর এই চেষ্টা থেকে অর্জিত সাফল্যের মূলে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো প্রেরণা।
এই প্রেরণা-কে রূপকে দেখা যায় গাছের পাতা হিসেবে। প্রেরণা ছাড়া জীবন আর পাতা ছাড়া গাছ অনেকটা একই রকম- সৌন্দর্যহীন, বিফলা। প্রেরণা থাকলেই জীবনের সঠিক মূল্য খুঁজে পাওয়া যায়, মানুষ সঠিক পথ খুঁজে পায়। আর প্রেরণাহীন জীবনে মানুষ সাফল্যের পথ থেকে দূরে সরে যায়, জীবন হয়ে ওঠে হতাশাপূর্ণ। ফলে মানুষ জীবন নিয়ে খুশি হতে পারে না। সাফল্যকে গুরুত্ব দিতে শিখে না। জীবন জটিলতায় পড়ে যায়। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। প্রেরণা না থাকলে মানুষ কেবল বড় বড় সাফল্যের পিছনে ছুটতে থাকে। আর পরাজিত হয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। কোন পথে গেলে সাফল্য অর্জিত হবে তা বুঝে উঠতে পারে না।
প্রেরণা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিটি মানুষের জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রেরণার প্রয়োজন পড়ে থাকে। একটুখানি প্রেরণাই পারে যে কারো জীবন বদলে দিতে। প্রেরণা মানুষের মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে আলোর পথে ধাবিত করতে সাহায্য করে থাকে। এক কথায়- প্রেরণা অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে সাফল্যের পথে মানুষকে ধাবিত করে থাকে।
একজন মানুষের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি করার অন্যতম কৌশল হলো প্রেরণামূলক বক্তব্য বিনিময়। অনেক অসম্ভব কাজ কেবল কিছু কথার মাধ্যমে ও সুন্দর ভাবে করানো যেতে পারে। প্রেরণামূলক কথা মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে থাকে। এই যেমন Chico Xavier–এর এই দর্শনটি অনুসরণ করা যায়,
“প্রত্যেকের জীবনের একটা গল্প আছে। অতীতে ফিরে গিয়ে গল্পের শুরুটা কখনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তুমি গল্পের শেষটা চাইলেই নতুন করে সাজিয়ে তুলতে পারো।”
কেবল অপরের কথা বা জীবনাদর্শ দ্বারা নয়, নিজেকেও অনুপ্রাণিত করার কিছু কৌশল আছে। bdpsychologist.com অবলম্বনে নিচে ১০টি উপায় তুলে ধরা হলো:
১। নিজেকে “কেন” প্রশ্ন করুনঃ আমরা যদি না জানি কেন আমরা কাজটি করছি, তাহলে কাজটি করার পিছনে কোন তাগিদ থাকবে না। আমরা ক্যারিয়ার গড়তে চাওয়া, পৃথিবীকে বদলিয়ে দিতে চাওয়া কিংবা কোন অবিশ্বাস্য কিছু প্রমাণ করতে চাওয়ার মত এই কারণ গুলো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমেরিকার বিখ্যাত মোটিভেশনাল বক্তা সিমন সিনিক একটা গোল্ডেন বৃত্ত এর কথা বলেছেন- প্রথমে, কেন তারপর কিভাবে, এবং কি? এই মুহূর্তে কোন লক্ষ্য না থাকলে দ্রুত একটা লক্ষ্য ঠিক করে ফেতে হবে। যেমন- দ্রুত পড়া, কিভাবে শিখতে হয় কিংবা কি করে কারো সামনে কথা বলতে হয়।
২। লেগে থাকুনঃ ডানিং ক্রুগার ইফেক্ট অনুযায়ী, আমার যখন নতুন কিছু শিখতে যাই তখন আমরা অনেকেই খুব আত্মবিশ্বাসী থাকি। কিন্তু যখন শিখতে শুরু করি, তখন বুঝতে শুরু করি যে কাজটা শেখা কতটা কঠিন, আমাদের কতটা যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে, আমাদের অনুপ্রেরণা কমে যায় আর আমরা অনেকে দ্রুত হাল ছেড়ে দেই। এখানে সফলতার কৌশলটি হল এই অবস্থায় হাল ছেড়ে না দেয়া। একবার ঐ বিষয়ে পারদর্শী হয়ে গেলে আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে আসবে।
৩। ফিডব্যক জেনে নিনঃ একজন ম্যারাথন দৌড়বিদ জানেন দৌড়ের শেষ মিনিটে দর্শকদের অনুপ্রেরণা ফলাফলে কত বড় ধরনের পার্থক্য এনে দেয়। তাই, ফলাফলের জ্ঞান হল একটা শক্তিশালী চালিকা শক্তি যা সবারই কাজে আসে। কাজেই কাজ শুরু করে দিয়ে নিজের সম্পর্কে পরিচিত জনদের কাছ থেকে ভাল মন্দ প্রতিক্রিয়া জেনে নিন তাতে অনুপ্রেরণা পাবেন। ফিডব্যাক জানার একটা উপায় হল- উপদেশ কিংবা পরামর্শ নেয়া। বেশিরভাগ মানুষ এই উপদেশ দিতে ভালবাসে এবং ভালবোধ করেন।
৪। পরামর্শদাতা খুজে নিনঃ বিজ্ঞজনের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। যে আপনাকে উৎসাহ দিতে পারে এবং যার উৎসাহ দেবার ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করেন এমন বিচক্ষণ ব্যক্তির পরামর্শ নিন। এতে, উৎসাহ পাওয়া যায়, নতুন ভাবনা পাওয়া যায় এমনকি জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যায়। কাজেই আপনার চারপাশে পছন্দের এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকুন এবং প্রয়োজনে কাজে লাগান।
৫। অজুহাত পরিহার করুনঃ কোন রকম অজুহাত দেখাবেন না। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের ভঙ্গুর ইগোর ব্যর্থতা ঢাকতেই আমরা অজুহাত দেখাই। বারবার করতে হয় এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজে এটা আরও খারাপ অবস্থার তৈরি করে। অর্থাৎ যখন আপনার কোন বড় লক্ষ্য থাকে এবং আপনি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ছোট ছোট অভ্যাস ও কাজ করার পরিবর্তে অজুহাত দেখান তখন লক্ষ্য অর্জন ব্যহত নিশ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, আপনার ওজন কমাতে নিয়মিত হাঁটতে হবে, অথচ আজকে বৃষ্টি হচ্ছে তাই হাঁটবেন না ঠিক করেছেন। জর্জ ওয়াশিংটন কারভার “৯৯% ব্যর্থতার জন্য এই অজুহাত দেখানো অভ্যাসকেই দায়ী” করেছেন। কাজেই ক্ষতিকর এই অভ্যাস আজই ত্যাগ করুন।
৫। ইতিবাচক প্রাইমিংঃ ইতিবাচক প্রাইমিং দিয়ে দিনের শুরু করুন। প্রাইমিং হল, অল্প কিছু সময় ব্যয় করে নিজের চিন্তা-ভাবনা এবং আবেগকে সমন্বয় করে নেয়া। কানাডার একদল গবেষক দেখেন যে, কল সেন্টারের যে সকল বিক্রয় কর্মী ফোন করার সময় সফলতা প্রকাশ করে এমন ছবি দেখেছিল তারা অন্যদের তুলনায় ৫০% বেশি সফল হচ্ছিল। লাইব্রেরীতে আমারা সবাই অনেক স্মার্ট হয়ে যাই কেননা সেখানে আমরা সবাই অনেক বেশি চিন্তায় নিমগ্ন হতে পারি। অনেকে ভাল পোশাক পরে, সোজা হয়ে দাড়িয়ে হাত ও মাথা উপরে তুলে কাজে বেশি সফল অনুভব করেন। কাজেই, নিজের ইতিবাচক প্রাইমিং করে নিয়ে আমরা অনুপ্রাণিত হতে পারি।
৬। বাজি ধরুনঃ জীবনকে একটা খেলা হিসেবে নিন এবং নিজের উপর বাজি ধরুন। ওজন কমানোর জন্য বিশ্বের অনেকই বাজি ধরে ওজন কমিয়েছেন। কাজেই জীবনে কিছু অর্জনের জন্য বাজি ধরুন দেখবেন জিত আপনার হবেই।
৭। নিজের অগ্রগতি পর্যালোচনাঃ নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন- কোন কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা অসম্ভব বলেই মনে হয়। তাই নিজের অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় নিজের বর্তমান অবস্থা কেমন। এটা অগ্রগতির নির্দেশ করে। ভাল গানের শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রথম দিনের রেকর্ড রাখেন। এক বছর পরে যখন ঐ রেকর্ড ছাত্রদের দেখান তখন বেশিরভাগ ছাত্রই তাদের অগ্রগতি দেখে অবাক হয়ে যায়। তাছাড়া অতীত সফলতা বর্তমান কাজের সফলতাকেও ত্বরান্বিত করে। কাজেই নিজের কাজের অগ্রগতি দেখে নিয়ে আমরা নিজে নিজেকে অনুপ্রেরণা দিতে পারি।
৮। অল্প দিয়ে শুরু করুনঃ ছোট সহজ একটি কাজ দিয়ে শুরু করুন। কাজটি সফল হলে, আমরা অনুপ্রাণিত হই এবং নতুন আর একটা কাজ শুরু করি। এটাকে নিজে নিজে মনোশক্তি বাড়ানোর চক্র বা স্বয়ংক্রিয় মনোবল বৃদ্ধির চক্র বলা হয়। আমরা যদি শুরুতে খুব কঠিন কাজ দিয়ে শুরু করি তাহলে মনোবল ভেঙ্গে যায়, যা হতাশার জন্ম দেয় এবং কাজটি শুরু করার আগেই থেমে যায়। যেমনঃ গান গাওয়া শিখতে চাইলে দু-–চার দিনরাত পরিশ্রম না করে প্রতিদিন ৫মিনিট করে চেষ্টা করুন। একটু একটু করে একদিন গান গাওয়া শিখে যাবেন, নয়ত দু-চারদিনের কঠোর পরিশ্রমে হতাশ হয়ে গান শেখার ইতি টানবেন।
৯। ইতিবাচকদের সংস্পর্শে থাকুনঃ বিখ্যাত লেখক জিম রন লিখেছেন, সাধারণত আমরা গড়ে ৫জন মানুষের সাথে বেশির ভাগ সময় কাটাই। তাই অণুপ্রেরিত হতে পরিবর্তনে বিশ্বাসী ইতিবাচক মনের মানুষদের সাথে মিশুন। নেতিবাচক মানুষরা প্রত্যেক সমাধানের মধ্যেই সমস্যা খুঁজে পায়। কাজেই, সর্বদা ইতিবাচক প্রগতিশীল মনের ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকুন এবং তাদের সাথে সময় কাটান।
উইনস্টন চার্চিল ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তবে রাষ্ট্রনায়কের চেয়েও দুর্দান্ত বাগ্মী হিসেবে আজও তিনি বিশ্বালোচিত। তাঁর স্মৃতি শক্তিও ছিল প্রখর। চার্চিলকে যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সেরা ব্রিটেনবাসী হিসেবে মনোনীত হন। প্রায় ৫০ বছর তিনি রাজনীতির প্রথম সারিতে ছিলেন। চার্চিলের একটি উিক্তি আছে, যা যুগের পর যুগ মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘তুমি যতদূর পিছনে তাকাবে, ততদূর সামনে দেখতে পাবে।’
লেখক: ফজলুর রহমান, রচনা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।