অর্থনীতির ক্যান্সার হুন্ডি ও অবৈধ অর্থ পাচার
মো: জিল্লুর রহমান::
অর্থ পাচারের প্রধান ও আলোচিত মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি। হুন্ডি কারবারিরা সারা বিশ্বে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এরা বেশ শক্তিশালী ও সদা সক্রিয়। মুহুর্তের মধ্যে তারা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা ও সক্ষমতা রাখে। এসব ব্যবহার করে মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরাও বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি বানাচ্ছেন, জমি কিনছেন, কারখানা গড়ছেন। ব্যবসায়ীরা দেদারসে অর্থ পাচার করছেন আমদানি-রপ্তানির আড়ালে; আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে। নির্ধারিত এজেন্টের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় হুন্ডির টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতির উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাতে কারও কোন সন্দেহ নেই। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও অশনিসংকেত এবং অনেকে এটাকে অর্থনীতির ক্যান্সাের বলে অভিহিত করেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) এর মতে, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে হুন্ডিচক্র এতটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছে যে, ব্যাংকিং বা অন্য যে কোনো মাধ্যমের চেয়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই তারা গ্রাহকের ঠিকানায় টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, হুন্ডি হচ্ছে অর্থ পাচারের একটি ভয়ঙ্কর মাধ্যম। কেননা আমদানি বা রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র প্রদর্শন করতে হয়। এর ফলে অপরাধীর পরিচয় একসময় পাওয়া যায়। কিন্তু হুন্ডিতে মূলত এজেন্টের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হয়। এটি পুরোপুরি চলে বিশ্বাসের ওপর। এখানে কোনো কাগজপত্রের লেনদেন হয় না। এ প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার করা হলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরে খরচ কম। এ কারণেই পাচারকারীরা হুন্ডিকেই পছন্দ করে বেশি। শুধু বাংলাদেশ থেকে অর্থ যায় না, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ আসেও। বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। মূলত যারা অবৈধভাবে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছে, তারাই বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপ বলছে, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে।
বাণিজ্য কারসাজি করে অর্থ পাচারের তালিকায় বাংলাদেশের নাম বিশ্বের ৩০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। বাণিজ্য কারসাজিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যায় মূলত দুইভাবে। একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে অর্থ পাচার; আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। রপ্তানির সময় কম দাম দেখানোর ফলে বিদেশি ক্রেতারা যে অর্থ পরিশোধ করছেন, তার একটি অংশ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসছে শুধু সেই পরিমাণ অর্থ, যে পরিমাণ অর্থের কথা দেখানো হচ্ছে অর্থাৎ কাগজপত্রে যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটা। অনেক সময় পণ্য আমদানি রপ্তানির ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে খালি কনটেইনার বা এক পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্য আসা-যাওয়া করেছে, এমন উদাহরণও রয়েছে।
অবৈধ হুন্ডি প্রতিরোধের কারণে নিকট অতীতে বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ বহুলাংশে বেড়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা এখন অনেক সচেতন। তারা অবৈধ পথ এড়িয়ে বৈধপথেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন। বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে, শুধু বাড়েনি, নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক এবং দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা অপরাধ, যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সব সময়ই তৎপর আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে হুন্ডির কোনো তথ্য থাকে না। তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচার নিয়ে যারা কাজ করে, এর মধ্যে জিএফআই অন্যতম। তাদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ কমেছে।
তবে সর্বসাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়ার হার উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে কারণ হিসেবে মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো চালু হওয়া, নতুন বৈদেশিক নিয়োগ কমে যাওয়া এবং প্রবাসীদের চাকরি হারানোর মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬.৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য আরও বলছে, বাংলাদেশ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের চেয়ে ৭৭১.৬ মিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স পেয়েছে।
জিএফআই এর একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার বা ৯৮ হাজার কোটি টাকা, ২০১৪ সালে ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা এবং ২০১৩ সালে ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ লাখ ৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা- যা বাংলাদেশের প্রায় দুটি বাজেটের (২০১৯-২০২০) সমান৷ তবে বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালের পর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা প্রকাশ করতে পারেনি জিএফআই৷ কারণ হিসেবে তারা বলছে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশ ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি৷ তাই অন্যান্য দেশের ব্যাপারে ২০১৭ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন করা হলেও বাংলাদেশের জন্য হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি৷ অন্যদিকে জিএফআই বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। বাংলাদেশে পণ্য আমদানি রপ্তানির সময় এ কারসাজি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও থাইল্যান্ডে। এর বাইরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম নিয়ে অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে সেখানে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। তবে সেসব ব্যাংকে কারা টাকা রেখেছেন সে সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। শুধু সুইজারল্যান্ডেই নয়, একইভাবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ক অর্থ পাচার হচ্ছে। সত্যিকারভাবে দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। যে অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়তো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতো। ব্যাংক কর্মকর্তা এবং আইনজীবীদের মতে, অর্থ পাচার হয়ে গেলে সেটি আবার দেশের ভেতরে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ।
দেশের টাকা দেশে এবং অর্থ পাচার বন্ধ করতে হলে সবার আগে বাজেটে বিনিয়োগের সুযোগগুলো বৃদ্ধি ও পাচারের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের প্রধান উৎস হলো কালো টাকা। কালো টাকার উৎসগুলো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ হবে প্রথম পদক্ষেপ। এছাড়া অর্থ পাচার ও কালো টাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তির দুই একটি উদাহরণ সৃষ্টি করলে এ প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে।
অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ আরো উন্নত করতে হবে। বিনিয়োগে যদি সময় বেশি লাগে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে তবে উদ্যোক্তারা আসবে না। তাই নীতিমালাগুলো আরো সহজ ও স্পষ্ট করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বন্ধ করতে হবে। প্রতি বছর বাজেটে নীতিমালা পরিবর্তন করা যাবে না। বন্দর, আইটি, অবকাঠামোগত সুবিধা আরো বাড়াতে হবে। তার আগে দেশীয় বিনিয়োগ কারীদের উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায় অর্থ বাইরে পাচারের ঝুঁকি থেকেই যাবে। দেশের লোক যদি অর্থ নিয়ে বিদেশে চলে যায় তবে বিদেশিরা আসবে না। এক্ষেত্রে দেশে সঞ্চয়ের সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। আমানতকারীদের ব্যাংক হার বাড়াতে হবে। সঞ্চয়ের সুদহার, আমানতের হার কমিয়ে দিলে মানুষ টাকা রাখতে উৎসাহ পায় না।
তাছাড়া বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনার খরচ কমাতে হবে। রেমিট্যান্সের প্রণোদনার ব্যবস্থাটি চলমান রাখতে হবে। মনিটরিং আরো জোরদার করতে হবে। শাস্তির বিধানগুলো কার্যকর করতে হবে। রেমিট্যান্সের অর্থ যাতে গ্রাহক দ্রুত পেতে পারে বাজেটে এমন কিছু করতে হবে। কারণ মানুষ হুন্ডিতে যাওয়ার প্রথম কারণ হলো অর্থ দ্রুত পাওয়া। যেকোনো অঞ্চল থেকে মানুষ দ্রুত হুন্ডিতে অর্থ পায় বলেই এটি জনপ্রিয় হয়েছে। তাছাড়া, ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে যোগসাজশে বা মিলেমিশে দুর্নীতি ও অনিয়মের নজির দেখা যাচ্ছে। এদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ছোট ব্যাংকগুলো মার্জ করার বিষয়ে ভাবা উচিত। ব্যাংকের গ্রাহক সেবা বাড়াতে হবে। তাহলে ব্যাংকের প্রতি মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠবে। অর্থনীতির ক্যান্সার হুন্ডি প্রতিরোধ করতে না পারলে এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে প্রতিনিয়ত বাঁধাগ্রস্ত করতে থাকবে। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক, মো: জিল্লুর রহমান
ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স