বোতলজাত বাতাসের যুগে পৃথিবী! মুক্তি কোথায়?
ফজলুর রহমান::
১. আমরা এরইমধ্যে পেয়ে গেছি অক্সিজেন বালক, কেনিয়া, ২০২১। গত নভেম্বর মাসে পরিবেশ বিষয়ক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা এনভায়ারমেন্টাল ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার ২০২১-এর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ উদ্যোগ ক্যাটেগরিতে পুরস্কৃত হয় একটি ছবি, যেখানে এক কিশোরের মুখে মুখোশ ও শ্বাস নেবার নল সংযুক্ত করা হয়েছে টবের একটি গাছের সাথে। টবটি যেন তার অক্সিজেনের ট্যাংক, তার পাশে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশের ক্ষতিকে সামনে এনে জোরালো বক্তব্য এই ছবি- দ্য লাস্ট ব্রেথ। ছবিটি তুলেছেন কেনিয়ার নাইরোবিতে কেভিন অচিয়েং অনিয়ানগো। এই ছবিটি শুধু যে আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে তুলে ধরেছে তাই নয়, শিল্পের ইতিহাসেও ছবিটি তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। নিঃশ্বাস নিতে পারার গুরুত্ব কতখানি, কত সহজে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ভেঙে পড়তে পারে তা এই ছবিটি বুঝিয়ে দিচ্ছে।
২.বায়ুতে অক্সিজেনের পরিমাণ ২১ ভাগ। যদি কোনো কারণে এর ঘাটতি হয়ে অন্য গ্যাসের ঘনত্ব বা ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যায়, তবে তাকে দূষিত বায়ু বলে।আমরা গত কয়েক দিন ধরে আরেকটি নিউজ ঘুরপাক খেতে দেখছি। যা প্রকাশ করে বৈশ্বিক বায়ু মান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টি বড় শহরের মধ্যে বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল শীর্ষে। একিউআই অনুযায়ী, উক্তদিন সকালে ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ২৮৯। এ সময় দিল্লি, স্কোপিয়ে ও উলাটবাটরের বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ১৯৬, ১৯৫, ১৯২। গবেষণা মতে, বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে খুব অস্বাস্থ্যকর বলে ধরা হয়। দুই কারণে ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমটি বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি।
৩. বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার- তাদের প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায়ুদূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বায়ু দূষণের স্বীকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রতিটি শিশুর ৩০মাস করে আয়ু কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি, যদিও উন্নত দেশগুলোয় এই হার গড়ে পাঁচ মাসের কম। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০জনের মধ্যে নয়জন দূষিত বায়ু গ্রহণ করে। গবেষকরা বলছেন, যেসব বয়স্ক মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম তারা সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের ঝুঁকিতে আছেন। কারণ, তারা প্রায়ই ঘরের বাইরে নানা ধরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।
৪. ৯০’ এর দশকে বোতলজাত পানির কথা আমাদের চমকে দেয়। কে কিনিবে তাহা? পরে দেখা যায়, অল্প সময়েই বোতলের দখলে বাজার। তিন দশক আগে যা কল্পনা ছিল, এখন তা বাস্তবতা। আগে কী ছিল? দীঘির পানি সুপেয় ছিল, পুকুরেও স্বচ্ছ পানি মিলতো। নালা-খাল থেকেও পাওয়া যেত মোটামুটি নিরাপদ পানি। খাবারের দোকান কিংবা সবখানেপানি ছিল ফ্রি। পানি পানের জন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হতো না।পানি বিক্রি করতে মানুষের আত্মসম্মানে লাগত। সহজলভ্যতা বুঝাতে বলতে হতো ‘পানির দামে একেবারে’।তখন বোতলজাত পানির কথার ভাবনাটায় অমূলক। এখন আর ফ্রি পানি দেওয়া হয় না। খাবারের সঙ্গে পানিও কিনতে হয়। প্রথমদিকেবোতলজাত পানি পান ছিল আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। এখনআর দশটা পণ্যের মতো আজ পানিও বিক্রি হচ্ছে। কিনে খেতে হচ্ছে। শুরুতে ব্যবসাটি ছিল ছোট পুঁজির উদোক্তাদের। হাল আমলে পানি ব্যবসায় নেমে পড়েছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
৫. একজন ইতালিয়ান আর্টিস্টও ১৯৬০ সালে নিঃশ্বাসের বাতাসের গুরুত্ব নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। যেখানে তিনি লাল একটি বেলুনে নিজের নিঃশ্বাস সংরক্ষিত রাখার ছবি আঁকেন। শিল্পীর সেই কল্পনা এখন ভিন্নভাবে আমাদের দুয়ারে হাজির। পানির মতো বোতলভর্তি বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রির সময়ে প্রবেশ করে ফেলেছে বিশ^।পানির পাশাপাশি বাজারে এখন বিক্রি শুরু হয়েছে ‘বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস’। যুক্তরাজ্যের কোস্ট ক্যাপচার এয়ার নামের একটি কোম্পানি কাচের বোতলভর্তি উপকূলীয় এলাকার টাটকা বাতাস বিক্রি করছে। বোতলপ্রতি তারা বিক্রি করেছে ১০৫ ডলার; যা আমাদের দেশের প্রায় ৯ হাজার টাকার মতো! বিশ্বের বিভিন্ন দূষিত এলাকার মানুষ ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেই কিনতে শুরু করেছেন বোতলগুলো। কোস্ট ক্যাপচার এয়ার বিশ্বের একমাত্র কোম্পানি নয় যারা এভাবে বাতাস বিক্রি করে। ভিটালিটি এয়ারের মতো বাতাস বিক্রির বড় বড় ব্র্যান্ডও রয়েছে, যারা কানাডিয়ান রকি মাউন্টেন, এয়ার ডি মন্টকুক কিংবা ফরাসি গ্রামাঞ্চল থেকে বাতাস সংগ্রহ করে বিকিকিনি করে।ডেইলী মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, তাদের প্রতিনিধি দেশটির অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখতে পায় পিওর ফ্রেশ নিউজিল্যান্ড এয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ৪ বোতল বাতাস বিক্রি হচ্ছে ৯৮ ডলারে। দেশটিতে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে বোতলজাত বাতাস বাজারে আনে তারা। বাজারজাত করার পর বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আর ঐ বোতলজাত বিশুদ্ধ বাতাস বিক্রি করে ভালো দাম পাচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি দ্বীপে মেঘের খুব কাছাকাছি এমন উচ্ছতা থেকে বাতাস বোতলজাত করা হয় বলে জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘আপনি জীবনভর যে বাতাস নিঃশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ এটি’।দক্ষিণ এশিয়া বায়ুদূষণের দিক থেকে শীর্ষেই রয়েছে। সে হিসেবে এখানেও যদি ‘ভিটালিটি এয়ার’ এর তৈরি বোতলজাত বাতাস চলে আসে তাতে চমকে ওঠার কিছু নেই।
৬. পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৯ জনের মধ্যে ১ জনই কেবল বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়। স্ট্রোক থেকে বার্ষিক ১.৪ মিলিয়ন এবং হৃদরোগে ২.৪ মিলিয়ন মারা যায়। ডব্লিউএইচও রিপোর্ট থেকে জানা যায়, স্বল্প-আয়ের এবং সাধারণ দেশগুলোতে বায়ুদূষণের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।মানুষ বায়ু দূষণ থেকে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় স্বাস্থ্যের প্রভাব ভোগ করে, শরীরের প্রায় প্রতিটি সিস্টেমে রোগ এবং জটিলতা সৃষ্টি করে। যে সমস্ত লোক দূষিত বায়ুর পাশাপাশি ঘরের বাইরে বা ঘরের অভ্যন্তরে বায়ুদূষণের সংস্পর্শে থাকে তাদের ফুসফুসের ক্যান্সার এবং নিউমোনিয়াসহ শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। কার্বন-মনোক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাসগুলো মানুষের অনেক রোগের কারণ হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বায়ু দূষণ কীভাবে মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে ক্রমশ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
৭. বায়ু দূষণ কমানো গেলে কিভাবে উপকৃত হবে বাংলাদেশ? বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন মতে, বায়ু দূষণ রোধ করা গেলে মোটামুটি ৫ ভাবে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। এরমধ্যে রয়েছে:
১. গড় আয়ু বাড়বে: স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার বলছে, বায়ু দূষণ রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়বে এক বছর তিন মাসের বেশি।
২. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: বায়ু দূষণ রোধ করা গেলে সবচেয়ে বড় যে উপকারটি হবে সেটি হবে ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহায়তা’। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রকোপ রোধে বায়ু দূষণ রোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা: বায়ু দূষণের জন্য মানুষের শরীরে যেসব রোগের সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে, সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে যদি দূষণ রোধ করা যায়। মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে দেবে। ফুসফুসের সমস্যা, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ অনেক রোগ কমে যাবে।
৪. প্রতিবন্ধী সমস্যা: প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেয়ার সংখ্যা কমে যাবে, তেমনি শিশু ও মানুষের গড় আয়ু বাড়বে। একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় ধরে বায়ু দূষণের ভেতর দিয়ে যায়, তাহলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সেটা কাটিয়ে ওঠা যাবে দূষণ রোধ করতে পারলে।
৫. অর্থনৈতিক সুবিধা: বায়ু দূষণ কমানো গেলে একদিকে যেমন মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও। নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।
যেসব কারণে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ এতো বেশি?
বায়ু দূষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, “গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের দেশ হওয়ায় শীতের সময়ে হিমালয়ের পরের সব দূষণ এদিকে চলে আসে।কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয় আমাদের নিজেদের অনেক দূষণ। এধা দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে বায়ু দূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চারপাশে ইটভাটা, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন তো বায়ু দূষণের একটি কারণ। সেই সঙ্গে শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণ কাজের বায়ু দূষণ হচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় অতিরিক্ত সময় ধরে চলছে, সেগুলো অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করছে, এসবও বায়ু দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠাণ্ডা করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ু দূষণ আরো বাড়ছে।”
৮. বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি একেবারে মিলবে এমন কথা নেই। তবে সবস্তরে সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকায় এই দূষণ অনেকখানি রোধ করা যায়। দূষণের উপরোক্ত কারণগুলোতে নজর দিতে হবে। এরপর টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সকলকে অনুধাবণ করতে হবে দিনশেষে কেউ নিরাপদ নয়। আমরা যে যাই করি তাই যুক্ত হচ্ছে বায়ুমন্ডলে। থেকে যাচ্ছে বাতাসে। এই বাতাসের ভাষা বুঝার একটি তাগিদ দিয়ে গেছেন লেকখ জন মুর। তাঁর কথাগুলোও মনে রাখতে পারি।জন মুর বলেছিলেন, “বাতাসের পদার্থগুলি মানুষের চোখের জন্য খুব পাতলা, তাদের লিখিত ভাষাটি মানুষের মনের পক্ষে খুব কঠিন এবং তাদের কথ্য ভাষাটি বেশিরভাগ কানের জন্য খুব দূর্ব”
লেখক: ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এবং প্রাবন্ধিক ও রচনাসাহিত্যিক।