যদি আব্বা একবার আসেন !
মারিয়াফ রাখী:: ঘুম ভেঙ্গে গেল পবিত্র আযানের ধ্বনিতে। বেশ কয়েকদিন পর আজ কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবো না। আযানটা এতো করুন ও মধুর লাগলো ঠিক আব্বা চলে যাবার দিন যেমনটি লেগেছিল।
কেউ মারা গেলে আমি খুব ভয় পেতাম ছোট বেলায়। বেশ অনেকদিন একা একা থাকতেই পারতাম না। আমার ফুফাতো বোন রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আমাদের বাসায় ওনার লাশ নিয়ে আসে আমি তখন অনেক ছোট, বেশ মনে আছে প্রায় এক বছর আমি ওখান দিয়ে একা হাঁটতে পারিনি।।
আমরা দুই বোন খুব ভূতের ভয় পেতাম। আমি অবশ্য এখনও পাই। ছোট বোন তিথি যেনো বেশি ভয় না পায় সে জন্য নিজে হাজার ভয় পেলেও ওর সামনে সাহস দেখাতাম। ও আমাকে ছোট্ট বেলায় ‘আপা’নি’ বলে ডাকতো। ” মায়া” কি আমি তখন থেকে বুঝতে শিখেছি। কি যে মায়া লাগতো আমার সেই “আপানি” ডাকটির ভেতর!
সময় গড়িয়ে সেই ‘আপানি ‘ ডাক থেকে হলাম “পানি” তারপর একবারে ” রাখী” বলে সম্বোধন শুরু করলো। আম্মার এবসেন্সে ওর ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতেও কোথায় এক মায়া আমাকে জড়িয়ে ধরতো। তাই ঘুমের মধ্যে ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতেও খুব সাহসী হয়ে যেতাম। ফুফাতো বোনেরাও আমাদের দেখাশোনা করার মেয়েটা দেখে বলতো বোনের জন্য এতো মায়া! নিজেই তো এখনও একা যেতে পারেন না।
আমাদের দুই বোনকে ছোট বেলা থেকে বড় হওয়ার পরেও আদর করে পুরো গুষ্টি আপনি আপনি বলে ডাকতেন।
যাই হোক, ভয় বিষয়টি আমার ভেতর থেকে যেনো রিমোর্টে প্রেস করার মতো এক নিমেষেই উধাও হয়ে গিয়েছিল যেদিন আমার বটগাছ, শক্তি, আমার আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান।
আব্বাকে দাফন করে এসেই সেই জায়গায় আগরবাতি জালাই, মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওনাকে ডাকি ” আব্বা ” আব্বা” আব্বা”।
বাড়ি ভর্তি লোকজন আত্মীয় স্বজন যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন একা একা আব্বাকে রাখা সেই আগরবাতির জায়গাটাতে চলে যাই। ওমা কোথায় হারিয়ে গেছে আমার ভয় ??
সেই রাতে আমি কতো কথা বলেছিলাম মনে মনে আব্বার সাথে সারারাত ধরে,,, হুশ হয় যখন মধুর করুন সুরের আযানের ধ্বনি আমার কানে আসে।
কতো রাত ঘুমাতে পারিনি তখন। গুলশান ভাটারায় দাদাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাদা দাদীর কবরের পাশে আব্বাকে দাফন করা হয়। তাই আব্বার বারিধারা জে ব্লকের বাসা থেকে পূর্ব দিকে তাকিয়ে থাকতাম এমন ভোররাতে ,, বাড়ির পিছনের উঠোনটিতে দাঁড়িয়ে…. আর অন্ধকারে অস্ফুট চিৎকারে তাকে একটি বার আমাকে দেখা দিতে বলতাম।
অযু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম সেই খোলা উঠোনটিতে যদি আব্বা একবার আসেন !
না তিনি কোনোদিনই আসেননি। কেউ আসে না ………!শুধু স্বপ্নে এসেছেন।
কান পেতে থাকতাম তাঁর রাশভারি কন্ঠস্বর শোনার জন্য।
আমার জন্ম হওয়ার পর থেকেই দেখেছি আব্বা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। কখনোই তিনি নামাজ কাযা করেননি। কিন্তু যখন চলে গেলেন তখন ফজরের নামাজটাই শেষ বারের মতো পড়তে পেরেছিলেন।
আজ ফজরের আযানের ধ্বনিটা ঠিক এতো বছর আগের সেই করুন মায়াময় আযানের মতো মনে হলো।
আর কেউ কোনোদিন বলেননি এভাবে “খুব মজা হয়েছে রান্নাটা, অনেকদিন পর যেনো তোমার দাদীর হাতের রান্না খেলাম!” “রাখীর” গরুর মাংস রান্নাটা খুব ভালো হয়!
” মায়া” যেখানেই যাই এই মায়া শব্দটি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। সেখান থেকে দৌড়ে পালানোর সাধ্য আমার নেই।
লেখকঃ- মারিয়াফ রাখী
কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।