মুজিববর্ষের আলোচনা। ৭ই মার্চের ভাষণঃ অজানা অধ্যায় (২)
ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী::
দুনিয়ার সেরা ভাষণগুলো ছিলো লিখিত বা পয়েন্ট দেখে উপস্থাপন করা। এ সব বক্তব্য ছিলো অনেক চিন্তা ও গবেষণার ফসল। শুধু মাত্র কয়েকটি ভাষণ অলিখিত ছিলো। মহাকালের সাড়া জাগানো ভাষণের মধ্যে প্রথম অলিখিত ভাষণ মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘বিদায় হজ্জের ভাষণ’। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিলো অলিখিত। এ সব হৃদয় থেকে আসা, হৃদয়ের কথা। জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা একবার জানা হয়ে গেলে, শিখা হয়ে গেলে, আর জানতে হয় না, শিখতে হয় না। হৃদয়ের কথা বারবার শুনতে হয়। যেমন একটি গান, কবিতা, উপন্যাস বারবার শুনতে হয়, পড়তে হয়। কারণ এ সব হৃদয়ের কথা। ৭ই মার্চের বক্তব্য যেন একটি বক্তব্যে নয়, ছন্দবদ্ধ একটি কবিতা। তাই এই ভাষণ প্রদানের পর আমেরিকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করেন, ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ রাজনীতির কবি। রাজনীতিকের এই অমর কবিতাটি শতবার শুনলেও আমাদের পুরানো মনে হয় না।
বিশ্বের সেরা ভাষণগুলো সবই প্রদান করা হয় পূর্ণ নিরাপত্তাপূর্ণ স্থানে। কোনো কোনোটি ফুলে সাজানো মঞ্চে, ফুলের মালা গ্রহণ করে। ৭ই মার্চের ভাষণ কামান বন্দুকের গুলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ও অধিকারের সত্য উচ্চারণ করেছিলেন কঠিন পরিস্থিতি মুখোমুখিতে । একটি ভাষণ, একটি উঁচু তর্জনী, একটি নির্দেশ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হলে ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিতে পারে, দুই লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারাতে পারে, এটি এক বিশ্বের বিস্ময়। এই ভাষণ শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য নয়, এটি অনন্ত কালের অধিকারহারা মানুষের জন্য। তাই এখনো এই ভাষণের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। এখনো এই ভাষণ বাঙালিকে উজ্জীবিত করে, অনুপ্রাণিত করে। আজও যখন শুনি,’তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো’ মনে হয় তিনি স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি, প্রতিক্রিয়াশীল, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদেরকে এখনো অনুপ্রণিত করছে। কারণ পাকিস্তানি আদর্শের সাথে একাত্তরের অাদর্শের সংঘাত চার যুগ পরেও চলছে। যা দুনিয়ার কোথাও হয়নি।
৭ই মার্চের ভাষণের হাত ধরে একটি জাতির রাজনৈতিক জন্ম, একটি স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ। শুধু এটি আমাদের স্বাধীনতার সনদ নয়, মুক্তির সনদ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন। আর ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করেন পাঁচ বার। (১) আজ বাংলা মানুষ মুক্তি চায়। (২) এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। (৩) যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়। (৪) এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। (৫) এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে ‘মুক্তি’ শব্দটি পাঁচ বার বলার রহস্য বুঝতে হবে। এ দেশের মানুষকে স্বাধীন করে ছাড়বো না বলে, বললেন, মুক্ত করে ছাড়বো। আর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ পুরো ভাষণের শুধু এই বাক্যটির মধ্যেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি একবার উচ্চারিত হয়। এখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির পূর্বে ‘মুক্তি’ শব্দটি যুক্ত করেছেন। স্বাধীন তো ১৯৪৭ সালে একবার হয়েছিলাম,কিন্তু মুক্তি মিলেনি। এবারের স্বাধীনতা, শুধু স্বাধীনতার জন্য নয়, মুক্তির জন্য। তাই তিনি মুক্তির উপর বড় বেশি জোর দিলেন। একাত্তর সালে স্বাধীনতা অর্জিত। কিন্তু ‘মুক্তি’ মানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি। এই মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে এবং চলমান থাকবে। তাই একাত্তরের রণাঙ্গনে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা স্বাধীনতাযোদ্ধা নয়,’মুক্তিযোদ্ধা’। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি অপসারণ করে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে।
‘জয় বাংলা’, ‘সোনার বাংলা’ ‘মুক্তি’ শব্দমালা বঙ্গবন্ধুর অত্যান্ত প্রিয় ছিলো। এসব শব্দমালা রবীন্দ্র-নজরুলের। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রচণ্ড রবীন্দ্র-নজরুলের অনুরাগী। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী হতে আমরা জানতে পারি, তাঁর কারাজীবনের প্রধান সম্বল ছিলো রবীন্দ্র-নজরুল রচনা সমগ্র। কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘মুক্তি’। কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে দাগ কাটে। মুক্তির কথা তাঁর হয়ে উঠে ধ্যান জ্ঞান। মুক্তির জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেন। একদিন তিনি হয়ে উঠেন বাঙালির মুক্তিদাতা।
‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান, জাতীয় শ্লোগান। এই ‘জয় বাংলা’ প্রথম উচ্চারণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এক প্রবন্ধে। নজরুলের ‘জয় বাংলা’, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’, একটি জাতীয় শ্লোগান, অন্যটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় কবি, জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা, জাতির জনক তিনজনই মারা গেছেন আগস্ট মাসে। একাত্তরের রণাঙ্গণে তিন মহাপুরুষের তিনটি বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। জাতীয় কবি নজরুলের শ্লোগান ‘জয় বাংলা’, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু-নজরুলের কাঙ্ক্ষিত ‘মুক্তি’-‘র লক্ষ্যে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বিশেষ ভাবে বাঙালি বাংলা জয় করেছিলেন বলেই আমাদের জাতীয় এক দিবসের নাম ‘বিজয় দিবস’। দুনিয়ার কোনো জাতির বিজয় দিবস নেই, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আছে। যে জাতির বিজয় দিবস আছে, সে জাতি কোনোদিন পরাজিত হতে পারে না। (চলমান)
লেখক, কলামিস্ট ও রাজনীতিক।