মেহেদি পাতা | মারিয়াফ রাখী
মারিয়াফ রাখী:: থমথমে ভাব ধরেছে আকাশটা, চৈতালি হাওয়াটা আজ গোমড়া মুখে বসে আছে কোন সমুদ্দুরে! সাহরির সময় গড়িয়ে ভোর হতে চলেছে চোখের পাতায় এক টুকু ঘুম এসে জড়ো হয়নি।
এফবির টাইমলাইন থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরে বন্ধ কাঁচের জানালাটায় চোখ পড়লো, আলো ফুটে উঠেছে, এগিয়ে গিয়ে কাঁচটা সরাতেই ঘন কালো মেঘের দর্শন পেলাম, মুহুর্তেই মনটা নেচে উঠলো, তাহলে কি আজ বৃষ্টিরানীর দেখা মিলবে!
খুব খেয়াল করে মেঘেদের গতিবিধি পর্যালোচনা করতে লাগলো অবুঝ মন!
আচ্ছা মন কি সবসময় অবুঝই থাকে? কথায় আছে মনের নাকি বয়স হয় না! কি জানি হবে হয়তো!
আমি নিজেকেই বুঝতে পারি না আর তো মনের খবর!
নাহ্, বৃষ্টির দেখা মেলা ভার। মনে হচ্ছে গোমড়া মুখী আবহাওয়াটা বেশ জ্বালাবে আরও ক’দিন।
আমি ইদানিং তৃষ্ণা সহ্য করতে পারি না, গলা শুকিয়ে কি যেনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আটকে যায়, পানির তৃষ্ণাটা তীব্রভাবে জেঁকে বসে তখন। তার উপর এখন রোজা রেখে কি হয় তাহলে!!
ইফতার বানাতে কিচেনে ঢুকে পরন্তবেলায় রীতিমতো কাহিল অবস্থা।
মেঘেদের আনাগোনা দেখতে দেখতে কিছুটা রাগও হচ্ছিল। ধ্যাত বৃষ্টির জন্য মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে গেছে।
আকাশের দিক থেকে নজর সরতেই দৃষ্টি আটকে গেলো নিচে পাশের বাসার উঠোনের কোনায় মেহেদি গাছটায়।
কিছুদিন আগেও গাছটিতে পাতা ছিল না বললেই চলে, এখন সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। চেয়ে রইলাম বেশ খানিকক্ষণ।
নিজেকে আজকাল আমার মেহেদি পাতার মতো মনে হয়, উপরটা সবুজ আর ভেতরটা টুকটুকে লাল!
বুঝতে শেখার পর থেকে আমি খুব বেশি মেহেদি দিতাম হাতে। কেনো যে এতো ভালো লাগতো জানি না। তখন টিউবের মেহেদির প্রচলন সবে মাত্র হচ্ছিল।
আমার কিন্তু ঐ ছেলেবেলার বাটা মেহেদির প্রতি অদম্য এক আকর্ষণ কাজ করতো। সবুজ পাতা গুলো ছোট্ট হাতের তালুতে লেগে ধীরে ধীরে কি লাল বর্ণ ধারন করতো, আমি পুরো সময়টা চেয়ে থাকতাম হাতের দিকে……!
মাঝে মাঝে আম্মা খুব রাগ হতেন, দুদিন পর পর মেহেদি বাটা চাই চাই বলে। বাসায় সাহায্যকারী দু’তিন জন মেয়ে সবসময়ই থাকতো। আমি তাদের দিয়ে আশে পাশের বাসার মেহেদি পাতা আনিয়ে বাটতে বলতাম। সবাই বলতো হাতে মেহেদির রঙ তো এখনও মুছে যায়নি এর উপর আবার মেহেদি দিলে বড় হলে সতীন হবে।
আমি ওদের সেসব কথায় পাত্তাই দিতাম না!
মনে মনে বলতাম, আমি যাকে ভালোবাসবো সে কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেই না!!!
আজ ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মন বলছে ওরাই ঠিক বলতো…..!
মেহেদি পাতার রঙটা হয়তো খুব বেশি গায়ে লেগে গেছে!
জীবনের রঙে সবুজের ভেতর লাল রঙটা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
মেহেদির রঙ না মুছতেই হাত রাঙানোর শখটা যে বুকটাই লাল রক্তাক্ত করে দিবে! সেদিন বুঝিনি!
একবার মায়ের উপর ভিশন রাগ হলো, যাকে মেহেদি আনতে পাঠাতে চেয়েছি তাকে অন্য কাজে লাগিয়ে দিয়ে আমাকে এক ধমক দিয়েছিলেন বলে।
বেশ মনে আছে, আমি দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গেটের কাছে বসে ছিলাম গোমড়া মুখ করে, যেই আব্বার গাড়ির হর্ন শোনা গেছে অমনি দৌড়ে পকেট গেট খুলে বাইরে চলে গেলাম। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আব্বা গাড়ি থেকে তাড়াহুড়া করে নেমেই স্বভাবজাত ভাবেই কোলে নিয়ে জানতে চাইলেন, কি হয়েছে কেনো গাল ফুলিয়ে আছি।
আমি বললাম আমার এক্ষুণি একটি মেহেদি গাছ লাগবে। ব্যস্ উনি সাথে সাথে বাসার সাহায্যকারী ছেলেটাকে পাঠিয়ে মেহেদি গাছ আনালেন।
খুব ঘটা করে সুন্দর একটি টবে সেই গাছটি লাগানো হলো। আমার ভাইয়ারা ও বাসার সবার উপস্থিতিতে।
ওহ্ একটু বলে নেই, আমার মা কিন্তু খুব বকা খেয়েছিলেন সেদিন আমার জন্য।
আমি বকা খেলেই আব্বার জন্য অপেক্ষা করতাম কখন তাকে বিচার দিবো!
এরপর তো হলো আরেক কাহিনী! এখন আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার দেখি গাছে নতুন পাতা হয়েছে কি না, দুপুরে ও বিকেলেও, এমন কি ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আমার একবার দৃষ্টি চলে যায় মেহেদি গাছের ডালের দিকে!
এভাবে কয়েকদিন পার হলো, আমি আবার গেটের সামনে মুখ গোমড়া করে বসে আছি। যথারীতি আব্বার গাড়ি দেখে দৌড়ে কাছে গিয়েই কান্না শুরু করে দেই, আমার গাছে কেনো নতুন পাতা ধরছে না! এটা পঁচা গাছ এনেছে, আমাকে কোলে নিয়ে আব্বা ওনার মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার কান্না শুনেছিলেন সেদিন, সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো, আমি ভোর বেলায় উঠোন বাগানে গিয়ে খুশিতে চিৎকার শুরু করলাম। বাসার সবাই ছুটে এসে দেখলো আমার মেহেদি গাছটায় নতুন পাতা ধরেছে!
আমি তখনই আব্বার কাছে আবদার করলাম মিষ্টি নিয়ে আসতে, আমি সারা পাড়ায় মিষ্টি বিলাবো।
সময় মতো মিষ্টি আসলো বাসায়, আম্মা প্লেটে করে সবার বাসায় সেই মিষ্টি বিলি করতে পাঠালেন। পরে বাসার মেয়েগুলো এসে বললো সবাই নাকি অবাক হয়ে বলেছে, মেহেদি পাতার জন্য মিষ্টি!!
আজ আব্বাকে খুব মনে পড়ছে। উনি কি আকাশের তারা হয়ে দেখতে পাচ্ছেন, তার সেই ছোট্ট রাখী নিজেই আজ ‘মেহেদি পাতা’ হয়ে গেছে …….!
মারিয়াফ রাখী, লেখক ও সংগঠক।