শিশু-কিশোরদের নতুন মানসিক রোগ ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ সাবধান থাকুন
ফজলুর রহমান:: কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, “আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।” গানের সুরে বলতে হয়, “পুতুল খেলার দিন ফুরোল জানি না কখন!” এখনতো কিছুক্ষেত্রে ‘ম্যালা’ লেখাপড়ার ধারাও যাচ্ছে ভিন্ন দিকে। পড়ার টেবিলে মনও বসে না ঠিকঠাক। কেন এমন হচ্ছে শিশুকিশোরদের একটি অংশের! বিশেষজ্ঞরা এটাকে চিহ্নিত করেছেন ‘ডিজিটাল গেম আসক্তিজনিত রোগ’ হিসেবে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে এখন এমন গেমারের সংখ্যা প্রায় ১২০ কোটি। এই গেমারদের বেশিরভাগই শিশু ও টিনএজার৷ গড়ে সপ্তাহে তিনদিনেরও বেশি তারা কম্পিউটার গেমস খেলেন৷
ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ সবসময় ছিল। যা ডিজিটাল সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। আর এই আসক্তিকে ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণীকরণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গেমিংয়ে আসক্ত ব্যক্তি মূলত অন্য সব কিছুর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া কারো সঙ্গে মিশতে না পারা, অসময়ে ঘুম, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম তো রয়েছেই। এ ধরনের আসক্তিকে বলা হয়, ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে গেমারদের দুই থেকে তিন শতাংশ ‘গেমিং ডিজঅর্ডারে’ ভোগে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোগব্যাধির শ্রেণি বিন্যাসের তালিকায় এই আসক্তিকে ”গেমিং রোগ” বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে। ভিডিও গেমে আসক্তিকে একটা আচরণগত সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই আচরণে আসক্তির সব লক্ষ্মণ রয়েছে অর্থাৎ বারবার এই খেলার প্রবণতা দেখা যায় এবং এর থেকে সরে আসা কঠিন বলেও দেখা যায়। এছাড়াও ”জীবনের অন্যান্য সব কিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পায়” এই গেমিং-এর নেশা।
মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বলছিলেন, ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তিতে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি মেধা বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মনোবিদদের মতে, প্রতিনিয়ত এসব ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরণের হরমোন নি:সরণ হয়। এতে শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে সে হয়তো গেমে আসক্ত।
বিষয়টিকে নজরে নিয়ে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করেছে বলে বিবিসি সূত্রে জানা যায়।
আসলে বিশ্বের অনেক দেশই গেমিংয়ের আসক্তি নিয়ে চিন্তিত। দক্ষিণ কোরিয়ায় তো সরকার এমন আইন করেছে যাতে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুরা মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অনলাইন গেম খেলতেই না পারে। জাপানে কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। চীনের ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট শিশুরা কতক্ষণ গেম খেলতে পারে তার সময় বেঁধে দিয়েছে। কোন কোন দেশে ভিডিও গেম খেলার নেশাকে ইতিমধ্যেই বড়রকম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়েছে।
https://youtu.be/j-mucy3I81w
বিশ্লেষকেরা বলেন, মাদকাসক্তির মতোই ক্ষতিকর গেমসে আসক্তি।আর এ থেকে বের হতে হলে চিকিৎসা করাতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ক্ষতি চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।
১। অসময়ে ঘুম: অধিকাংশ শিশুই রাত জেগে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গেমস খেলতে থাকে।দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় ধরে এমন কার্যক্রমে ঘুমের সমস্যা তৈরি হয়। স্বাভাবিক ঘুম নষ্ট হয়। অনিয়মিত ঘুমের চক্র সৃষ্টি হয়।
২। দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা: শিশুদের চোখে চশমা দেখাটা এখন যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছেস। মাত্রাতিরিক্ত ভিডিও গেইমসে আসক্তি ছোট্ট শিশুর চোখের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে । খুব কাছ থেকে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি মাথাব্যথাও দেখা দিচ্ছে।
৩। চিন্তাশক্তির হ্রাস: এ সময়ে শিশু-কিশোরদের চিন্তা বা পর্যবেক্ষণ করার সময়টুকু কেড়ে নিয়েছে টিভি বা ভিডিও গেইম। শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানের অভাব তো আছেই, টিভিতে এমন অনেক কিছুই দেখানো হয় যা বাস্তবাতার সাথে অসামঞ্জস্য। তাই শিশুর চিন্তা করার শক্তি কমে যায়।
৩।বিরূপ আচরণ তৈরি: মারামারি বা ধ্বংসাত্মক ভিডিও অতিরিক্ত বেশি দেখার ফলে শিশুর উগ্র স্বভাব ও আচরণগত সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কখনো কখনো তা সহিংস আচরণও তৈরি করে। পড়ালেখায়ও অমনোযোগী করে তোলে।
৪। ভুল অনুকরণ: শিশুরা অনুকরণ করতে বেশ অভ্যস্ত। টিভিতে বা মোবাইল গেমসে এমন অনেক চিত্র সে অনুকরণ করার জন্য খুঁজে বেড়ায়। যা সবসময় সুখকর হয়ে ওঠে না। ফাইটিং গেম বা গোলাগুলির গেম অতিমাত্রায় খেলা তাকে উগ্র করতে পারে। ভয়ানক কাহিনী শিশুকে মানসিক ভাবে ভীত করে দেয়।
৫। সমাজ থেকে দূরে সরে যাওয়া: অতিরিক্ত ভিডিও গেম খেলা শিশুদের মাথায় কেবলই গেম বা গেমবিষয়ক বিষয়বস্তুই ঘোরাফেরা করে।তারা সমাজের অন্য বিষয়গুলো থেকে দূরে চলে যেতে শুরু করে।গেমের আসক্তি তাদের অসামাজিক করে তুলতে পারে।
৬। একাকীত্ব: শৈশবে বন্ধুরা একসাথে খেলবে, মিশবে, হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখবে এটাই হওয়ার কথা। ।এ সময় নতুন বন্ধু তৈরি হয়। করার জন্য শৈশবই আদর্শ সময়। ভিডিও গেমস বা টিভির প্রতি আসক্তি অন্যদের সাথে যোগাযোগ বা কথা-বার্তা বলার ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয়। এমনকি বাবা-মার সাথেও সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
৭। মানসিক সমস্যা: ভিডিও গেইমসের প্রতি আসক্তি বেড়ে গেলে তা এক সময় এসে মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায়। যস মানসিক সমস্যায় রূপ নেয়। নতুন কিছু কল্পনার জায়গা থেকে শিশুরা সরে আসে। এতে করে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যহত হতে পারে।
এই আসক্তি থেকে শিশুদের ফেরাতে সহজ কিছু উপায় সম্পর্কে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
১। সহজলভ্যতা দূর।
শিশু যদি ছোট হয় (৫ বছর পর্যন্ত) তবে কোনো পরিস্থিতিতেই শিশুর হাতে মুঠোফোন বা ভিডিও গেম তুলে দেযা যাবে না। বাড়ির খুব দরকারি জিনিসের মতো মুঠোফোনও একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস মনে করতে হবে, কেবল শিশুর খেলার সামগ্রী নয়। মা–বাবাও যদি মুঠোফোনকে সেভাবে চিহ্নিত করেন, তাহলে শিশুরাও অবশ্যই বুঝবে ব্যাপারটা।এরপর একটু বড় হয়ে গেলে তাদের টিভি বা মুঠোফোনে আসক্তির খারাপ দিকগুলো বোঝানো উচিত।
২। শিশুদের একাকীত্ব দূর।
অনেক সময় মা,-বাবা দুজনই ব্যস্ত থাকলে শিশুর দেখাশুনা করার লোক তাকে টিভির সামনে বসিয়ে নিজের কাজ সারেন। ফলে শিশুরা আসক্ত হয়ে পড়ে টিভিতে। এই প্রবনতা থেকে দূরে থাকতে হবে। শিশুকে সময় দিতে হবে। প্রয়োজনে শিশুর খেলার সাথী হতে হবে। মাঝেমধ্যে শিশুদের নিয়ে ঘোরাঘুরির দিন নির্ধারণ করতে হবে।
৩। নতুন নতুন জিনিস শেখানো।
শিশুর জন্য বিভিন্ন সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা করতো হবে। শিশুকে কিছু বিনোদনের মধ্যে থাকতে শেখাতে হবে। সমবয়সীদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতে হবে।
৪। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
শিশুর মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা জরুরি। যদি শিশুদের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা বাড়ে, তাহলে টিভি, মুঠোফোন বা ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে অনেক সহজেই শিশুদের দূরে রাখা সম্ভব হবে।
৫।নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে রাখুন ।
অনেক সময় বিভিন্ন গেমস ও কার্টুন চরিত্র শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে। এসব মাধ্যমে দেখানো বিভিন্ন মারপিট বা সহিংস দৃশ্য শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত ঘটায়। তারা অতিরিক্ত সচেতন হয়, অতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু কী দেখছে। সে ক্ষেত্রে শিশুকে কাছে নিয়ে একসঙ্গে বসে ওকে সঠিক ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন। অন্যথায় অচিরেই শিশুর মনের মধ্যে অকারণ জটিলতা, ভয় বা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। নানা রকম মানসিক রোগেও আক্রান্ত হতে পারে তারা। শুধু তাই নয়, যেকোনো কাজে মনোসংযোগ করতেও তাদের অসুবিধা হয়।
৬। ঘুমের আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে রাখুন। শিশুকে খাওয়ানোর সময় বা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের বাজে অভ্যাস বাদ দিতে হবে। এটা অসম্ভব মনে হলেও কয়েক দিন অভ্যাস করলেই এটা সহজ হয়ে উঠবে। বরং গল্প বলুন, ছড়া, গান, তেলাওয়াত শোনানো যেতে পারে। এতে শিশুরা অনেক ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবে, নতুন বিষয় সমন্ধেও জ্ঞান বাড়বে।ঘুমাতে যাওয়ার আগে মন বিক্ষিপ্তও থাকবে না।
সূচনার মতো সমাপ্তিও টানছি কবি সুফিয়া কামাল এর ছন্দে, যা তিনি বলেছিলেন কচিকাঁচাদের উদ্দেশ্য করে, “তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভু নাহি হবে আর আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার। শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।”
লেখক, ফজলুর রহমান,
রচনা সাহিত্যিক এবং উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।