এভাবে কীটপতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেলে কী পরিণতি হবে?
ফজলুর রহমান:: ১.পতঙ্গের পথ খুঁজে নিতে আলোর দরকার পড়ে । বিশেষ করে, চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলোর। এজন্য আগুনকে সূর্য ভেবে এগিয়ে যায় পতঙ্গ। তবে শেষে এসে পুড়ে মরে। এ বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক ভেবেছেন। কিন্তু তেমন নিশ্চিত হতে পারেননি।
তবে হাল ছাড়েননি একজন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার অধ্যাপক হেনরি হাইসো। বলা যায়, তিনি পতঙ্গের অনুসরণ শুরু করলেন। তিনি দেখলেন আলোর দিকে সরলরেখায় চলে যাচ্ছে পতঙ্গ। কিন্তু মোমবাতির আগুন তো আর সহস্র মাইল দূরে নয় চাঁদ বা সূর্যের মতো। তাই বেশি আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর শেষে তাল হারিয়ে গিয়ে আগুনে পড়ে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের কীটতত্ত্ববিদরা ১৯৭০ সালের দিকে একটি তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। সেটি ভালোবাসা ঘটিত। মোমবাতির আগুন থেকে যে ইনফ্রা রেড (অবলোহিত) আলো নিঃসৃত হয়, নারী মথও তেমন আলো ছড়ায়। তাই পুরুষ মথ আকৃষ্ট হয় আর প্রাণ ত্যাগ করে। তাই বলা যায়, পতঙ্গ আলোর ধাঁধায় পড়ে প্রাণ হারায়, নিজের ইচ্ছায় নয়। এভাবে ইচ্ছের বিরূদ্ধে প্রাণপাতের আরো ঘটনা আছে বিশ্বজুড়ে। যা বিপদ ডেকে আনছে পতঙ্গ বাস্তসংস্থানে।
২. প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে কীটপতঙ্গের আগমন ঘটে। কীটপতঙ্গের জগতটা খুবই বৈচিত্র্যময়। প্রাণিজগতে সবচেয়ে বেশি প্রজাতি আছে কীটপতঙ্গ শ্রেণীতে, পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রাণিজগতের প্রায় ৮০ শতাংশই কীটপতঙ্গ। কীটপতঙ্গের রয়েছে প্রায় দশলাখ প্রজাতি। এর বাইরেও নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কীটপতঙ্গের মধ্যে একটি বড় অংশ রয়েছে যারা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বেশ উপকারী। ছোট পিঁপড়া থেকে শুরু করে ঘরের কোণের আরশোলা এবং বাহারি প্রজাপতি ও ঘাসফড়িং সবই কীটপতঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। মাটি থেকে শুরু করে গাছপালা, জলাশয়, ফসলের মাঠ এমনকি আমাদের বসতবাড়িতেও এদের দেখা যায়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী এ প্রাণীগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিবেশে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝে যে আন্তঃসম্পর্ক ও খাদ্যজাল গড়ে উঠেছে তা কীটপতঙ্গ ছাড়া ভাবাই যায় না।
৩.বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত বিপদ বেড়েই চলেছে। মানুষের থাকার জায়গা আর খাবারের যোগান বাড়াতে গিয়ে বন উজাড় চলছে। ভূমির ব্যবহার বহুগুনে বেড়েছে। এসব কারণে পৃথিবীর অনেক এলাকায় কীটপতঙ্গের বাস্ততন্ত্র ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে – এমন তথ্য উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
সম্প্রতি নেচার জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে প্রথমবারের মত জলবায়ু সংকট এবং আধুনিক কৃষিকাজের মধ্যে স্পষ্ট ও উদ্বেগজনক এক যোগসূত্র প্রকাশ পেয়েছে। যেসব জায়গায় এই সংকট অনেক বেশি, সেখানে কীটপতঙ্গের পরিমাণ ৫০ শতাংশের মত কমে গেছে। আর কীটপতঙ্গের প্রজাতির সংখ্যা কমেছে ২৭ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার, ফসলের বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, বিশাল মাঠজুড়ে ফসলের ক্ষেত, এক জায়গায় অনেক বেশি গবাদিপশু- এরকম যে বিষয়গুলো আধুনিক কৃষিকাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেগুলোই কীটপতঙ্গ ধ্বংসে বড় ভূমিকা রাখছে।
বর্তমান সময়ে অন্যতম আলোচিত সমস্যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ুর পরিবর্তন। এ সমস্যার কারণে ভয়াবহ সংকটর মুখে গোটা পৃথিবী। জলবায়ুর পরিবর্তনে একদিকে যেমন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তেমনি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বেশি সংখ্যক পতঙ্গের প্রজাতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া অনেক পোকামাকড়ের জন্য কঠিন ব্যাপার। যেমন ভোমরা মূলত ঠান্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে অভ্যস্ত। ফলে অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আবার ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েও যেতে পারে, যা কৃষকের বিপদ বাড়াবে।
৪.পোকামাকড় ধ্বংস হয়ে গেলে বা খুব কমে গেলে কী ঘটবে? প্রথমত, জনস্বাস্থ্য এবং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভ গলসন সিএনএনকে বলেছেন, “আমাদের ফসলের তিন-চতুর্থাংশের উৎপাদন নির্ভর করে কীটপতঙ্গের ওপর। কীটপতঙ্গ কমে গেলে ফসল উৎপাদন কমা শুরু করবে। স্ট্রবেরির মত অনেক কিছুই তখন আর ফলবে না। পোকামাকড় যদি দুনিয়ায় না থাকে, তাহলে এই সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষকে আমরা খাওয়াতেও পারব না।”
ইউনিভার্সিটি অফ রিডিংয়ের ফলিত বাস্তবিদ্যার অধ্যাপক টম অলিভার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমে যদি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সেখান থেকে আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরা সম্ভব না, তাহলে ক্ষতি কতটা বড় হবে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কি না, বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না।’ বিষয়টিকে তিনি তুলনা করেছেন উড়ন্ত বিমান থেকে নাটবল্টু খসে পড়ার সঙ্গে। কারণ সেটা চলতে থাকলে পুরো বিমানের অস্তিত্বই হুমকিতে পড়বে।
৫.কোন্ কোন্ জায়গায় কিভাবে কিভাবে কিটপতঙ্গ কমেছে- এ নিয়ে গবেষকরা কাজ করেছেন। গবেষণায় বিশ্বের এমন অঞ্চলগুলোতে কীটপতঙ্গ কমে যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে, যে অঞ্চলগুলো অনেক বেশি উষ্ণ, বিশেষ করে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল। আধুনিক কৃষির ব্যাপক প্রচলন হয়নি, এরকম এলাকায় কম উষ্ণায়ন ঘটছে। এসব এলাকার কাছাকাছি পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক আবাসস্থল পাওয়া গেছে। আধুনিক পদ্ধতিতে আগ্রাসী চাষাবাদ শুরু হয়নি, আশপাশে কীটপতঙ্গের প্রাকৃতিক আবাস্থল আছে এবং উষ্ণায়ন কম হয়েছে, এরকম এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে মাত্র ৭ শতাংশ। আর যেখানে ব্যাপক মাত্রায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে, উষ্ণায়ন বেশি হচ্ছে এবং পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক আবাস্থল কমে গেছে, সেসব এলাকায় কীটপতঙ্গ কমেছে ৬৩ শতাংশ।
৬.পৃথিবীতে যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোকামাকড় না থাকে তবে হয়তোবা খাদ্যাভাবে পড়তে হবে মানবজাতিকে। বছরে বিশ্বের ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল। গমের মতো শষ্য পরাগায়নের জন্য বাতাসের উপর নির্ভরশীল হলেও অনেক খাদ্যশস্য আছে যেগুলো পরাগায়নের জন্য পোকামাকড়ের উপর নির্ভরশীল। ফলে তারা হারিয়ে গেলে কৃষকরা বিপদে পড়বেন। পরাগবাহী পোকামাকড় হারিয়ে গেলে অনেক শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপাদন আর সম্ভব হবে না। ফলে আমাদের খাবার টেবিলে খাবারের পরিমাণ কমে আসবে। এমনকি চকলেট এবং কফির সংকটও দেখা দেবে। গুবরে পোকার মতো অনেক পোকামাকড় মৃত গাছপালা, মরদেহ এবং মল পচতে সহায়তা করে। এই পোকামাকড় না থাকলে পচন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হবে, যা পরিবেশ এবং মানুষ – উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে। বিভিন্ন উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মূল খাবার পোকামাকড়। ফলে পোকামাকড় কমলে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীও কমতে থাকবে।
৭.গবেষকদের মতে, কীটনাশক, অন্য আগ্রাসী প্রজাতি এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো কারণে পতঙ্গের বড় একটি অংশের বিলুপ্তি ঘটলেও তেলাপোকা, মশা-মাছির মতো পতঙ্গ এসব পরিবর্তনের মধ্যেও টিকে থাকার মতো প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। পাশাপাশি মাছি বা আরশোলার মতো কিছু পতঙ্গ মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এদের সংখ্যা বাড়ছে এবং আগামীতে আরও বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। এ বিষয়ে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভ গুলসন বলেছেন, “কিছু প্রজাতির কীটপতঙ্গের সংখ্যা হয়তো অনেক বেড়ে যাবে কিন্তু আমাদের যা দরকার সেই মৌমাছি, প্রজাপতি- এগুলো হারিয়ে যেতে থাকবে।”
৮.পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই দুনিয়ার ছোট-বড় প্রতিটি জীবেরই সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা জরুরি। যে কোনও জীবের অস্তিত্বের সংকটই এই দুনিয়ার জন্য বিপদের ইঙ্গিত। তাই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে কীট-পতঙ্গদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক পোকামাকড় গরমের দিনে ছায়ার জন্য গাছের উপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক আবাসস্থলের ক্ষতি এগুলোকে আরও অরক্ষিত করে তোলে। এই সংকট থেকে বাঁচতে আরও দেশীয় প্রজাতির এবং ফুলগাছ রোপণ করে, বাগানে কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে দিযে, এমনকি ঘনঘন ঘাস না কেটে আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেও ভূমিকা রাখতে পারি। কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে একফসলী চাষের পোকামাকড়বান্ধব কৃষি নীতি গ্রহণ করলে পোকামাকড় রক্ষা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বাগানে এবং শহুরে অঞ্চলে ফুল গাছ লাগিয়ে পোকামাকড় টিকিয়ে রাখায় ভূমিকা রাখা সম্ভব। কীটপতঙ্গের যৌনমিলন ও বংশবৃদ্ধির জন্য বড় গাছের ছায়া ও পঁচা পাতা দরকার – যাতে তাদের ডিম ও শূককীট বাস করে। চাষাবাদের কারণে এই পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কীটপতঙ্গ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে, গাছ লাগাতে হবে, ঝোপঝাড় বাড়াতে হবে, মাঠের আশপাশে ফুলগাছ লাগাতে হবে। বিপজ্জনক কীটনাশক বাজার থেকে দূর করতে হবে। কার্যকর পন্থা নিতে হবে যাতে কার্বন নির্গমন কমানো যায়। কীটপতঙ্গের পাশাপাশি মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পায়ন, নগরায়ন বা কৃষি কাজের মাধ্যমে পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা মাথায় রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
৯.কীটপতঙ্গ কমে গেলে বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা ঠিকঠাক চালু থাকবে কি না, কিংবা শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই হারিয়ে যাবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও চুড়ান্তভাবে আসেনি। তবে ধরণা করা হচ্ছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এখনই আমাদের কাজ করা ভালো, যাতে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের পতন দেখতে না হয়। কীটপতঙ্গ নিয়ে অধিক গবেষণা করে একটি সুন্দর বাস্তুসংস্থানের প্রতিবেশ গড়ে তোলা যায়। এতে একদিকে যেমন অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তেমনি জীববৈচিত্র্যও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর ড. এরিকা ম্যাক এ্যালিস্টার এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। তিনি বলেছেন- ‘পৃথিবীর সব কীটপতঙ্গকে আমরা যদি মেরে ফেলি, তাহলে আমরাও মারা যাবো।’