মতামত

ছাদবাগান তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমাতে পারে

ফজলুর রহমান:: ছাদবাগান থাকা মানে আরো বেশি মাত্রায় গাছের অক্সিজেনসমৃদ্ধ বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া। ছাদবাগানে গেলেই শরীরের কোষে কোষে পৌঁছে যাবে এই অক্সিজেন। এখানের ফুলের ঘ্রাণ মনকে ফুরফুরে করবে। এখানকার ফলের শোভা মনকে তৃপ্ত করবে। এই জায়গার সবুজ স্নেহ মনে আনবে ইতিবাচক প্রভাব।

এতো গেল মনের খবর। এবার দেহঘড়ির সংবাদটাও পড়ি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ছাদবাগানে নিয়মিত কাজ করা একটা চমৎকার ব্যায়াম হতে পারে। হাত-পায়ের মাংসপেশি ও সন্ধির এই ব্যায়ামে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। এক ঘণ্টা বাগানের কাজ করলে ১০০ থেকে ২০০ ক্যালরি ক্ষয় হয়। বাগানে কাজ করলে শারীরিক যে পরিশ্রম হয় তাতে ওজন কমাতে সাহায্য করে। একইসাথে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তে চর্বি নিয়ন্ত্রণে এটি কার্যকর। গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকলে বিষন্নতা দূর হয়। সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য মানুষের চোখকে আরাম দেয়, এতে চোখের ক্লান্তি দূর হয়।

দেহমন পেরিয়ে এবার আমরা বাড়ি-ঘরের খোঁজ নিই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি শহরের সব ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করা হয়, তাহলে তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো সম্ভব৷ শহরগুলোতে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাঁচে মোড়ানো বহুতল ভবন। এখন প্রায় সব জানালায় কাঁচ আছে। এখন ব্যবহার করা হচ্ছে শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস। ফলে সূর্য থেকে তাপ ও আলো এ ধাতব ও কাঁচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। এভাবে তৈরি হয় হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ। বারবার প্রতিফলনের কারণে উক্ত এলাকার তাপমাত্রা সামান্য হলেও বেড়ে যায় । ছাদ বাগান স্থাপন করা হলে বাগানের গাছের পৃষ্ঠদেশ এ তাপ শুষে নেয়  এবং গাছের গাছের দেহ থেকে যে পানি জলীয় বাষ্প আকারে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায় তা সে নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনে। অসংখ্য ছাদ বাগান এ প্রক্রিয়ায় শহরের উচ্চ তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গায় কংক্রিটের কাঠামো আছে, যা মূলত শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে৷ ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরের গাছপালার পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে কমে ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে৷ অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরের বছরে গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০০৯ সালে বেড়ে হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ এটা যে আরো বেড়েছে তা সহজে বুঝা যায়।

জানা যায়, ঢাকা শহরের চেয়ে গাজীপুরের তাপমাত্রা স্থানভেদে প্রায়২ থেকে ৪ ডিগ্রি কম৷ রাস্তার পাশে বা ছাদের বাগানে বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদের সংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়ানো হলে তাপমাত্রা  প্রায় দুই ডিগ্রি কমানো সম্ভব, যা বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অবদান রাখবে৷ এখন গাছপালা কমে এসেছে। ফলে অক্সিজেনের উৎপাদনও কম হচ্ছে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে৷ শহর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছাদবাগান প্রকল্প সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে তা কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ বেশকিছু ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা কমিয়ে দূষণ কমাবে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করবে৷ গাছপালা গ্রীষ্মকালে তাপ গ্রহণ করে এবং শীতকালে তাপ বর্জন করে পরিবেশের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করে৷

নগর সভ্যতা এখন অদমনীয়। আর নগর সভ্যতা মানেই যেন ইট পাথরের জঞ্জাল। শহর থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। শহরে সবুজকে ছড়ানোর জন্য অন্যতম অবলম্বল হলো ছাদ বাগান। খালি ছাদে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফুল, ফল, ঔষধি, শাক-সবজির বাগান গড়ে তোলাকে ছাদে বাগান বলা যায়।

অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদে বাগানের দেখা পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্বে মেসোপটিয়াম ও পারস্যের জুকুরাক নামীয় পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় বাগান ও ছোট গাছ লাগানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করার নিদর্শন পাওয়া যায়। পম্পেই নগরীর কাছেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রোমান ভিলায় কেবল একটি নির্দিষ্ট ছাদ তৈরিই করা হয়েছিল বাগান করার জন্য। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানও বিভিন্ন ছাদ ও বারান্দার সমন্বয়ে তৈরি বলে মনে করা হয় । বর্তমানে ইরাকের মসুল শহরের কাছেই আরেক ঝুলন্ত উদ্যানের নিদর্শন পাওয়া যায়।

ছাদ বাগানে টবে, ড্রাম কিংবা ট্রেতে রোপণ করা হয় নানা ফুল, ফল ও সবজি। কেউ কেউ আবার ছাদে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করে তাতে গাছ রোপণ করেন। ছাদ বাগান পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন হালকা পরিশ্রম ও বিনোদনের উৎস হিসেবেই গড়ে তোলা উত্তম। এতে পরিবারের নতুন সদস্যরা প্রবীণদের কাছ থেকে যেমন ফুল, ফল ও গাছপালা সম্পর্কে জানতে পারবে। নিজের হাতে গাছের যতœ নেয়ায় পরিবেশের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসারও জন্ম নেবে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে ছাদবাগানের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।

আগে ছাদবাগানের গুরুত্ব কম ছিল৷ তবে এখন মানুষ ছাদবাগানের দিকে ঝুঁকছে৷ একটা সময় বাড়ির ছাদে কিংবা ব্যালকনিতে গাছ লাগানো শখ মনে করতেন অনেকে৷ এখন আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে গাছ দেখা যাচ্ছে৷ যাদের ছাদ নেই, ভাড়া বাসায় থাকেন, তারাও বাসার ভিতরে, দরজার সামনে, সিঁড়ির গোড়ায় কিংবা ব্যালকনি থাকলে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাচ্ছেন৷ ছাদবাগান করতে উৎসাহিত করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান৷ বাড়ির মালিকদের ছাদবাগানে উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড় দিচ্ছে সরকার৷ যেসব বাড়ির মালিক ছাদে, বারান্দায়, বাসার সামনে বাগান করবেন তাঁরাই এ সুযোগ পাবেন৷ আর এ সুযোগ পেতেও অনেকেই এখন ছাদে বাগান করছেন৷ পৃথিবীর অনেক দেশে এখন ছাদে বাগান করা সে দেশের সিটি করপোরেশনের বাধ্যতামূলক আইন।

তাত্ত্বিক মার্কুয়াস টুলিয়াস সিসারোর একটি কথা আছে, ‘আপনার যদি লাইব্রেরি আর একটা ছোট্ট বাগান থাকে, তবে আপনি স্বয়ংসম্পূর্ণ।’চীনা প্রবাদ বাক্য বলছে, ‘তুমি যে দিন থেকে একটি বাগান তৈরি করা শুরু করবে, তোমার জীবনের শুরুও সেই দিন থেকেই।’ আর এ বিষয়ে গ্রিক প্রবাদ বাক্য হলো, ‘একটি সমাজ তখনই মহান রূপ ধারণ করে যখন সেই সমাজের বৃদ্ধরা বাগান তৈরি করতে শুরু করে, যেই বাগানের ছায়ায় সে কোনোদিনই বসতে পারবে না।’

দার্শনিক গার্ট্রুড জেকিল বলেন, ‘একটি বাগান একটি মহান শিক্ষক। এটা ধৈর্য্য এবং সতর্কতা শেখায়; এটি শিল্প এবং মিতব্যয় শেখায়; সর্বোপরি এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাস শেখায়।’ সাহিত্যিক ফ্রান্সিস বেকন বলেন, ‘ঈশ্বর সৃষ্টির কাজ শুরু করেছিলেন একটা বাগান তৈরির মাধ্যমে। আর এটাই মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।’ লেখক অস্কার ডি লা রেনটাউন এর এই কথাটিও এ প্রসঙ্গে মনে রাখা যায়, ‘আমি বিশ্রাম করার জন্য বাগান করাকে বেছে নিই। আমার কাছে সৃজনশীলতা এবং রং নিয়ে খেলা করার এটা একটা অনন্য মাধ্যম।’

আমাদের লাখ লাখ ছাদ আছে। অন্যদিকে কমে যাচ্ছে লাখ লাখ মাঠ-ঘাট। শহর এলাকায় হাঁটার জায়গাও তেমন মিলছে না। ছাদের সবুজায়ন তাই জরুরি। কারণ, ছাদ বাগান দেহ-মনের খোরাক যোগানোর পাশাপাশি পরিবেশের বড় উপকার করে চলে। তাই ছাদবাগান শুধু শখ থেকে নয়, পরিবেশের প্রয়োজনে বাগান করতে হবে৷ এতে করে পারিবারিক ফুল, ফল ও শাক-সবজির চাহিদা মিটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখারও সুযোগ রয়েছে৷

লেখক: ফজলুর রহমান, কলামিস্ট, রচনা সাহিত্যিক এবং উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button